দুধের জন্য উল্টো খামারিদের কাছে ধরনা
করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দিতেই দুধ নিয়ে চরম দুর্দশায় পড়েছিলেন পাবনা-সিরাজগঞ্জের খামারিরা। দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দেওয়ায় খোলাবাজারে পানির দরে দুধ বেচতে হয় তাঁদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ননি তুলে রেখে দুধ ফেলে দিতেও হয়েছে।
তখন ব্যাপক লোকসানে দিশেহারা খামারিরা দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো তখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চাহিদা না থাকার অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কিন্তু ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। দুধের জন্য এখন খামারিদের কাছেই প্রতিষ্ঠানগুলো ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাচ্ছে না। দাম লিটারে পাঁচ থেকে ছয় টাকা বাড়িয়ে দিয়েও দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ খামারিই এখন ছানা কারখানা ও খোলাবাজারে দুধ বিক্রিতে আগ্রহী। কারণ, সেখানে প্রতি লিটার দুধ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
হঠাৎ করে দুধের চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে খামারি ও প্রতিষ্ঠানগুলো দুটো কারণ তুলে ধরেছে। প্রথমটি হলো বন্যার কারণে গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে কাঁচা ঘাসও পাওয়া যাচ্ছে না। সুষম খাবার না পেয়ে গাভিগুলোর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। তাই সার্বিক দুধ উৎপাদনও কমেছে।
দ্বিতীয়টি হলো ঈদ উপলক্ষে দুধের চাহিদা বেড়েছে। তাই খামারিরা খোলাবাজারে ও ছানা তৈরির কারখানায় বেশি দামে দুধ বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদামাফিক দুধ পাচ্ছে না।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২৫ হাজার দুগ্ধখামার আছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ বাড়িতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে এ এলাকায় প্রায় ১০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়।
এই এলাকার গরুর দুধের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে সরকারি মিল্ক ভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেশ, অ্যামো মিল্ক, সেইফ মিল্ক, ইছামতি ডেইরি, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশ কিছু দুধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। উৎপাদিত দুধের বেশির ভাগই এসব প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে সারা দেশে বিপণন করে থাকে। ওই সব প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিলে পানির দরে খোলাবাজারে দুধ বেচতে হয় খামারিদের।
খামারি ও দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর কর্মকর্তারা জানান, এবার বন্যা দেখা দেওয়ার পর থেকেই দুধের উৎপাদন কমতে থাকে। বন্যার প্রভাবে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ দুধ উৎপাদন কমেছে। এরই মধ্যে আবার ঈদ উপলক্ষে দুধের চাহিদাও বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা দিয়ে থাকে। অথচ এখন ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দাম নির্ধারণ করেও প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ পাচ্ছে না। খোলাবাজারে ও ছানা তৈরির দোকানগুলোতে খামারিরা ৬০ টাকা বা তারও বেশি দামে দুধ বিক্রি করতে পারছেন। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে থাকা খামারিরা ছাড়া অন্য খামারিরা বাইরে দুধ বিক্রি করছেন।
বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় দুধের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুদিন আগেও ঠিকমতো দুধের ন্যায্যমূল্য দেয়নি। খামারিদের ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ এখন তারা খামারিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে।
মিল্ক ভিটার আওতাভুক্ত সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, সমিতিতে ১৩২ জন সদস্য আছেন। আগে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৮৫০ লিটার দুধ সংগ্রহ করা গেলেও এখন তার পরিমাণ প্রায় ৬০০ লিটার। খামারিরা বর্তমানে যে দাম পাচ্ছেন, তাতে তাঁদের পোষাচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে গো-খাদ্যের দামও বেড়েছে। সুতরাং দুধের দাম কমে গেলেই খামারিরা আবার লোকসানে পড়বেন।
দুধ সংগ্রহে ঘাটতির কথা তুলে ধরে প্রাণ ডেইরির প্রধান ডেইরি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (পাবনা–সিরাজগঞ্জ অঞ্চল) রাকিবুর রহমান বলেন, ‘এ অঞ্চল থেকে আমরা প্রতিদিন ১ লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করতাম। এখন তা অর্ধেকে নেমেছে। অথচ বাজারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের দুধের অনেক চাহিদা রয়েছে। খামারিদের কাছ থেকে দুধ পাচ্ছি না।’
ইছামতি ডেইরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রউফ বলেন, ‘২০ দিন ধরে দুধ সংগ্রহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ঈদ চলে আসায় ঘাটতি প্রকট হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন তিন হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করত। এখন খামারিদের অনেক অনুরোধ করেও কোনো দুধ পাচ্ছি না।’