এই আট কিলোমিটারে প্রতিবছরই ভোগান্তি
সমুদ্র বন্দর মোংলার সঙ্গে সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় খুলনা-মোংলা জাতীয় মহাসড়কের আট কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ। প্রতিবছরই জোড়াতালির সংস্কারে বছর না ঘুরতেই রাস্তার অবস্থা থাকে একই রকম। বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
খুলনা-মোংলা জাতীয় মহাসড়ক ঢাকার সঙ্গে খুলনা ও বরিশালের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই সড়ক ব্যবহার করেন। মোংলা সমুদ্র বন্দর, মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, মোংলা শিল্প এলাকা, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের ঘাঁটিসহ বিভিন্ন কারণে এই সড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কয়েক শ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিদিন খুলনা থেকে এই পথে মোংলায় এসে অফিস করেন। তা ছাড়া প্রতিদিন দেশ–বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বসহ অসংখ্য পর্যটক এই সড়কপথে মোংলা হয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ভ্রমণে যান। তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সড়কটির স্থায়ী সংস্কার হওয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানায়, খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ কিলোমিটার সড়কের মোংলা শিল্পাঞ্চল থেকে বেলাই ব্রিজ পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে মোংলা বন্দরের অংশে রয়েছে চার কিলোমিটার এবং সওজের অংশে চার কিলোমিটার। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই রাস্তার সংস্কার করা হয়। এরপর প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার কিছু কিছু অংশ সংস্কার হয়।
জাতীয় এ সড়কটির বন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় প্রায় অর্ধ শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বন্দরের জেটি থাকায় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে শত শত ভারী যানবাহন চলাচল করে। আবার ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে যানবাহন চলাচল করার কারণেও সড়কটি সংস্কারের পরও টিকছে না বলে দাবি সওজের।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের দিগরাজ বাজার থেকে শুরু করে বেলাই ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। রাস্তার বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। কোথাও কোথাও বিটুমিন উঠে মাটির রাস্তার মতো হয়ে গিয়েছে। দিগরাজ বাজারের সড়কের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বড় বড় গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এ পথ অতিক্রম করতে সব ধরনের যানবাহন সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের ওপর পড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খায়।
বাগেরহাট মাইক্রোবাস-পিকআপ চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ অপিরুদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সড়কের কোথাও না কোথাও নতুন নতুন গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও লম্বালম্বি ধসে নিচু হয়ে গেছে। অনেক সময় বাস-ট্রাক দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানের ওপর দিয়ে চলাচল না করে সড়কের পাশ দিয়ে চলাচল করায় কোনো কোনো স্থান ধসে যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এসব ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যায়। পানি জমে যাওয়ায় দ্রুত বিটুমিন ও পাথরের খোয়া উঠে নতুন নতুন গর্তে পরিণত হচ্ছে। সড়ক বিভাগ এসব ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে কোনোরকমে ইট-বালু ফেলে মেরামত করায় তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
খুলনার ট্রাকচালক আবুল শেখ বলেন, ব্যাপক খানাখন্দ ও গর্তের কারণে অনেক সময় ঝাঁকুনি খেতে খেতে সড়কের মধ্যে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়। আর গাড়ি উল্টে যাওয়া, গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়া তো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
মোংলার মৎস্য ব্যবসায়ী ওহিদুর রহমান বলেন, মাছ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলো খুলনায় অবস্থিত। মাছভর্তি পিকআপ নিয়ে তাঁরা খুবই বিপদে পড়েন। মোংলা থেকে খুলনা যেতে মাত্র ৪০ মিনিট লাগলেও এখন লাগছে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহাজাহান বলেন, এই সড়কটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা বন্দর সচল রাখতে সড়কটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। সড়কটি চালু রাখতে বন্দরের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, তা বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এই কাজ বৃষ্টির জন্য ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টি শেষ হলেই সংস্কার আবার শুরু হবে।
মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) মহাব্যবস্থাপক মাহবুব আহমেদ সিদ্দিক জানান, চলাচল অনুপযোগী খুলনা-মোংলা জাতীয় মহাসড়ক একটি বড় সমস্যা। ঢাকা থেকে এখানে আসার আর কোনো সহজ পথ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আসতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। রাস্তার করুণ দশার কারণে বিদ্যমান কারখানাগুলো বেনাপোল স্থলবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কাঁচামাল ও রপ্তানিপণ্য আনা-নেওয়ায় ঝামেলা পোহাচ্ছেন। তাঁরা প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে অভিযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাস্তার সমস্যার খুব দ্রুত স্থায়ী সমাধান চাই। তা না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের দেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।’
এ বিষয়ে সওজের বাগেরহাট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘খুলনা-মোংলা জাতীয় মহাসড়কের মোংলা বন্দরের চার কিলোমিটার আর সড়ক জনপথ বিভাগের চার কিলোমিটার রাস্তা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আমাদের অংশে নিয়মিত সংস্কারের কার্যক্রম হিসেবে সংস্কার করছি। তবে বর্ষা মৌসুমে বিটুমিন দিয়ে সংস্কার করা সম্ভব না। তাই আমরা প্রতিনিয়ত সোলিং এইচ বিবি করে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি, যাতে যাতায়াতের কোনো সমস্যা না হয়।’
প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন বলেন, সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রধান বা অন্যতম কারণ হচ্ছে ওভারলোড। এ ছাড়া আশির দশকের মাঝামাঝি এ রাস্তা নির্মাণের পর থেকে এখনো পর্যন্ত তা প্রশস্ত করা হয়নি। মাত্র ২২ ফুট চওড়া এ রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচলের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ কারণে সংস্কার করা হলেও তা স্থায়ী হয় না। এ জন্য স্থায়ী সমাধান হিসেবে রাস্তাটি ছয় লেনে উন্নীত করতে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে ঈদের পরপরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।