টিফিনের টাকায় অনন্য পথচলা
বছর পাঁচেক আগের কথা। পাবনার বেড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সাত-আট শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেয়, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তা মানবকল্যাণে কাজে লাগাবে। সেই থেকে শুরু। একপর্যায়ে ওদের সঙ্গে যোগ দেয় বেড়া পৌর এলাকার আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সবাই মিলে গঠন করে ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন’ নামের একটি মানবকল্যাণমুখী সংস্থা।
সংগঠনটি ইতিমধ্যে পাঁচ বছর পার করেছে। এর সদস্যসংখ্যা এখন ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ওরা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসংক্রান্ত সহায়তা থেকে শুরু করে দুস্থদেরও নানাভাবে সহায়তা করেছে। যেখানেই ওরা মানুষের অসহায়ত্বের খবর পেয়েছে, সেখানেই ওরা পৌঁছে গেছে। দুস্থদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী, শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ওদের আকুলতায় মুগ্ধ হয়ে এখন অনেক সচ্ছল ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ওদের তহবিলে অর্থসহ বিভিন্ন সামগ্রী দান করছেন।
নিজেদের জমানো টিফিনের টাকা ও হৃদয়বান মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তা মিলিয়ে ওদের সংগঠনের তহবিল মজবুত হতে শুরু করেছে। এই তহবিল নিয়ে তারা এখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়া মানুষের পাশে খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী নিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
করোনাকালে এই সংগঠনের সদস্যরা ইতিমধ্যেই অনেক দুস্থ ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। বেশ কয়েকজন অসহায় অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বেড়া পৌর এলাকার কয়েকটি ওষুধের দোকানে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র এবং থেরাপি ও নেবুলাইজার যন্ত্র কিনে দেওয়া হয়েছে। এসব ওষুধের দোকানে প্রকৃত দুস্থ রোগীরা বিনা মূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করছেন, রক্তচাপ মাপাতে পারছেন। এ ছাড়া বিনা মূল্যে থেরাপি ও নেবুলাইজেশনও করাতে পারছেন। অসহায় কারও ওষুধের প্রয়োজন হলে সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেক সময় তা কিনেও দেওয়া হচ্ছে।
করোনাকালে সংগঠনটির সদস্যরা ৯ জুলাই নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা বন্যাকবলিত শাহজাদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা চরবন্যা গ্রামের শতাধিক দরিদ্র নারীর মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেছে। বিতরণের সময় সংগঠনের নারী সদস্যরা এগুলো ব্যবহারের উপকারিতাসহ সচেতনতামূলক বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছে।
সংগঠনের সদস্যরা জানায়, ‘নারী সুস্থ থাকলে বাঁচবে শিশু’ স্লোগান সামনে রেখে তারা বন্যার্ত অসহায় নারীদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেছে। বন্যার্তদের মধ্যে তারা এ ধরনের আরও সামগ্রীসহ খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণের প্রস্তুতি নিয়েছে।
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের সভাপতি মেহরাব হোসেন (দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র) বলেন, ‘টিফিনের টাকা জমিয়ে ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। এরই মধ্যে শতাধিক শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি অনেক সচ্ছল ব্যক্তি আমাদের মাধ্যমে অসহায় মানুষদের সহায়তা করার ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। মানবকল্যাণের বিষয়টি এমন সফলতার মুখ দেখবে, তা সত্যিই আমরা ভাবিনি।’
সরকারি বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র রাহুল দাস ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘টিফিনের টাকায় একটি সংগঠনের জন্ম। ভাবতেই ভালো লাগে। আমি সাধ্যানুযায়ী আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সময় পেলেই ঢাকা থেকে বেড়ায় এসে ওদের কর্মসূচিতে শামিল হই।’
বেড়া বিতর্ক চর্চাকেন্দ্রের সভাপতি ও আলহেরা একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ওমর সরকার বলেন, ‘ওরা অসহায়দের মধ্যে চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে প্রায়ই ওদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি, যাতে ওরা উৎসাহ পায়। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মানবকল্যাণে এভাবে এগিয়ে আসার বিষয়টি সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো।’