৫০ পুলিশ পরিবারে স্বজন হারানোর বেদনা, সংক্রমণ-মৃত্যু কমেছে
পুলিশের পরিদর্শক রাজু আহমেদের ১২ বছর বয়সী ছেলেটা সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। আট বছরের মেয়েটা যখন-তখন বাবার জন্য কাঁদে। ওরা দুজনই স্কুলে পড়ে। ছেলেমেয়েদের সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পান না ওদের মা আফরোজা নাজনীন।
গত ২৪ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান রাজু আহমেদ। সারা দেশে রাজুর মতো ৫০ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বজন হারানো পুলিশ পরিবারগুলো এখন কেবল স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। তবে এখন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, প্রথম দিকের তুলনায় পুলিশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার দুটোই কমেছে।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার ভোরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি-দক্ষিণ) উপকমিশনার মো. মিজানুর রহমান (৪৭) ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ২৩ জুন চট্টগ্রামে তাঁর করোনা শনাক্ত হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তার এই প্রথম মৃত্যু হলো।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। গত ১৮ মার্চ ঢাকায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আর গত ২৮ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম পুলিশ সদস্য হিসেবে কনস্টেবল জসিম উদ্দিনের (৪০) মৃত্যু হয়। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) ওয়ারী ফাঁড়ির কনস্টেবল ছিলেন। এরপর একের পর এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হতে থাকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত আড়াই মাসে সারা দেশে ৫০ জন পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ডিএমপিরই ১৬ জন। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে করোনায় আক্রান্ত ১২ হাজার ৭৮০ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের দিক থেকেও ডিএমপিতে সর্বোচ্চ, ২ হাজার ৪৪৪ জন সদস্য।
সারা দেশে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৯ হাজার ১৯০ জনই সুস্থ হয়েছেন। গতকাল কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ১৩ হাজার ৮০৪ জন আর আইসোলেশনে ৫ হাজার ২ জন।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাবে এক হাজার ৮৯৮ জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) ৬৩৫ জন এবং বিশেষ শাখায় (এসবি) আক্রান্ত আছেন ৪৮৩ জন সদস্য। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩০ জন সদস্য। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফরিদপুরে করোনায় আক্রান্ত আছেন ২৪১ জন পুলিশ সদস্য।
করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন পুলিশ সুপার মর্যাদার কর্মকর্তা, ছয়জন পুলিশ পরিদর্শক, ১০ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ছয়জন এএসআই, একজন নায়েক, তিনজন সাধারণ কর্মচারী (সিভিল স্টাফ), ১৯ জন পুলিশ কনস্টেবল ও চারজন র্যাব সদস্য রয়েছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অপরাধী ধরতে অভিযান, সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে পাঠানো, দেশে ফেরা প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) নিশ্চিতকরণের মতো কর্তব্যের পাশাপাশি দুস্থ ব্যক্তিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো, করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফনে সহযোগিতা করা, হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে সাহায্য করার মতো মানবিক কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। ঘোর অসময়েও তাঁরা জনগণের মধ্যে থেকে কাজ করে গেছেন। তাতেই আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। আর পুলিশ ব্যারাকগুলোতে গাদাগাদির ফলে একজনের থেকে অনেকের মধ্যে রোগটি ছড়িয়েছে।
ঢাকায় এত পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় করোনায় সাধারণ মানুষ আক্রান্ত বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে থেকেই ডিএমপির সদস্যরা ডিউটি করছেন। সে কারণে ডিএমপিতে পুলিশ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা ব্যারাকেই থাকেন। ব্যারাকে ধারণক্ষমতার বেশি পুলিশ সদস্য থাকছেন। সেখানে বাইরে থেকে সংক্রমিত হয়ে ব্যারাকে এসে গাদাগাদি করে থাকছেন। একজন থেকে আরেকজনের মধ্য দিয়ে পুরো তলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, সংক্রমণ এড়াতে অনেক পুলিশ সদস্যকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। দুটি ব্যারাক খালি করে হাসপাতাল করা হয় ও আরেকটি হাসপাতাল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রথমদিকে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল, তখনকার তুলনায় এখন আক্রান্তের হার কমেছে।
ঢাকার বাইরের পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, গত ঈদে ও বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকে যাওয়া লোকজন এলাকাগুলোতে করোনা ছড়িয়েছেন। এরপর লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পুলিশকে প্রচুর বাইরে থাকতে হয়েছে। ফলে তাঁদের অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন।
ফরিদপুরে ২৪১ জন সদস্য আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ঈদুল ফিতরের আগে ফরিদপুরে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু ঈদের সময় ঢাকা থেকে লোকজন ফরিদপুর ঈদ করতে আসেন। আগে বন্ধ থাকলেও তখন ফরিদপুরের ভাঙ্গায় হাটবাজার চালু হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এখানে কেনাকাটা করতে আসেন। তাঁদের মাধ্যমে সেখানে ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। পরে একে একে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।
করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশের কাজ চালিয়ে নিতে সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) করেছে পুলিশ। এসওপি অনুযায়ী কাজের সময় প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের জন্য মাস্ক বাধ্যতামূলক। হাসপাতালে রোগী নেওয়া বা লাশ দাফনের সময় পিপিই পরতে হবে। জনসমাগমস্থলে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকে সুরক্ষাসামগ্রীর সংকটের মধ্যেও পুলিশ ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সুরক্ষা দিতে সংক্রিমত হয়েছে। তাঁরা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে স্থানসংকটে গাদাগাদি করে থাকায় একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের মধ্যে এখন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালেও চিকিৎসার মান উন্নত হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ এসওপি অনুযায়ী চলায় প্রথম দিকের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটিই এখন কমেছে।