ঝিনাইদহে বন্ধ হলো সড়কে চাঁদাবাজি
লাল পতাকা হাতে নিয়ে ঝিনাইদহের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে দাঁড়িয়ে বাস-ট্রাক থামিয়ে আদায় করা হতো চাঁদা। বিভিন্ন সংগঠনের নামে দিনের পর দিন চলেছে এ চাঁদাবাজি। জেলার ওপর দিয়ে চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহনের চালকদের কাছ থেকে কমপক্ষে ১২টি জায়গায় আদায় করা হচ্ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। এ চাঁদা আদায় নিয়ে মাঝেমধ্যেই চালক-আদায়কারীদের বাগ্বিতণ্ডা হতো। গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করার কারণে যানজটও লেগে থাকত।
সেই সড়ক, মহাসড়কে এখন আর চাঁদা আদায়কারীদের দেখা যাচ্ছে না। নেই কোনো যানজট। বাস-ট্রাক থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহন এখন ঝিনাইদহ জেলার ওপর দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। এটা সম্ভব হয়েছে ঝিনাইদহের বর্তমান পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাসানুজ্জামানের তৎপরতায়। তিনি এই জেলায় যোগ দেওয়ার পর সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তৎপর হন। সম্প্রতি চাঁদা আদায়ের স্পটগুলো উচ্ছেদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তারও করেছেন। যে কারণে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা এ চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে।
এসপি হাসানুজ্জামান বলছেন, এ কাজে তাঁর অনেক বাধা এসেছে। নানাভাবে মানসিক চাপেও ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ভালো কাজকে গুরুত্ব দিয়ে লড়াই করে গেছেন।
পরিবহনশ্রমিকেরা বলছেন, এই জেলা পার হতে ট্রাকগুলোকে পাঁচটি স্থানে আর বাসগুলোকে নয়টি স্থানে টাকা দিতে হতো। এ ছাড়া ছোট ছোট যানবাহনগুলোকেও চাঁদা দিয়ে চলতে হতো। বর্তমানে তাঁদের আর চাঁদা দিতে হচ্ছে না। আর চাঁদা আদায় করা শ্রমিকনেতারা বলছেন, এগুলোকে চাঁদা বলা যাবে না। শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রমিকদের নিকট থেকে টাকা নেওয়া হতো, যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
সাধারণ শ্রমিকেরা জানান, এ জেলার ওপর দিয়ে চলাচল করতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হতো। ট্রাকগুলোকে ঝিনাইদহ শহরের আলহেরা মোড়, চক্ষু হাসপাতাল মোড়, মিনি ট্রাক টার্মিনাল মোড়, কালীগঞ্জ শহরের মাইক্রোবাসস্ট্যান্ড ও ডাকবাংলো মোড় এলাকায় চাঁদা দিতে হতো। কোনো স্থানে ৩০ টাকা, আবার কোনো স্থানে ১০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো। এভাবে প্রতিদিন এ জেলার ওপর দিয়ে চলাচল করা কমপক্ষে ১ হাজার ৮০০ ট্রাকচালকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হতো। একইভাবে বাসচালকদের কাছ থেকে নয়টি স্পটে টাকা আদায় করা হতো। এগুলো হচ্ছে ঝিনাইদহ শহরের বাইপাস মোড়, আরাবপুর বাসস্ট্যান্ড, বাস টার্মিনাল, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, গাড়াগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, শেখপাড়া বাসস্ট্যান্ড, বিষয়খালী বাসস্ট্যান্ড, কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ও বারোবাজার। এই সড়কে চলাচলকারী গড়াই ও রূপসা পরিবহন থেকে টাকা আদায় করা হতো। জেলা শহর ছাড়াও উপজেলা ও বিভিন্ন ছোট ছোট শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে ছোট যানবাহনগুলো থেকেও টাকা আদায় করা হতো। এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় হতো, যা বিভিন্নভাবে ভাগ হয়ে যেত।
নজরুল ইসলাম নামের এক চালক জানান, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা চাঁদাবাজেরা সড়কে অবস্থান করত। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এই সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করতে হলে চাঁদা দেওয়াই লাগত। এভাবে ট্রাক চালিয়ে যাওয়ার পথে ঝিনাইদহ জেলায় পাঁচটি স্পটে তাঁকে টাকা দিতে হতো। এখন আর দিতে হচ্ছে না।
আমিনুর রহমান নামের এক বাসচালক জানান, স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে চাঁদা দিতে দিতে তাঁরা দিশেহারা। কোনো কারণ ছাড়াই তাঁদের কাছ থেকে এ টাকা আদায় করা হতো। সম্প্রতি চাঁদা ওঠানো মানুষগুলোকে সড়কে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশের তৎপরতায় এগুলো বন্ধ হয়েছে।
এসপি মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শক মহোদয়ের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তাঁর নির্দেশ পেয়ে এ চাঁদা বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে দ্রুত বিচার আইনে মামলা। বেশ কিছু স্পট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, পুলিশের তৎপরতার খবর পেয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে চাঁদা দাবি করলে চালকেরা সরাসরি তাঁর কাছে ফোন করছেন। তিনিও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। জেলার মহাসড়কে চারটি রুটে রাত্রিকালীন নিরাপত্তা প্রদান ও চাঁদাবাজি বন্ধে প্রতিদিন ১৮টি টহল দল কাজ করে যাচ্ছে।
ঝিনাইদহ জেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ওলিয়ার রহমানের দাবি, ওই টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হতো। ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি দাউদ হোসেন জানান, এগুলোকে চাঁদাবাজি বলা যাবে না। অসহায় পঙ্গু শ্রমিকদের কল্যাণে টাকা নেওয়া হতো। শ্রমিকেরা মারা গেলে তাঁর পরিবারকে টাকা দেওয়া হয়, সেটাও এ টাকা। তবে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, মহাসড়ক থেকে টাকা তোলা যাবে না। তাঁরাও বন্ধ করে দিয়েছেন।