করোনাকালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীরা বিপাকে
রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা আভিন নূরের মা আসমা উল হুসনা জানান, গত বছর আভিনের চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই গিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী আভিনের এখন একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি সেবা। কিন্তু এখন করোনা পরিস্থিতির কারণে এই সেবা বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘চেন্নাইতে ফলোআপেও যাওয়া হচ্ছে না। এদিকে ফিজিওথেরাপিও বন্ধ। বলতে গলে আমার মেয়েটার কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না। মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।’
আভিন তার অসুস্থতা নিয়ে একটি লেখা পাঠিয়েছিল। সেটি প্রথম আলোতে ছাপা হওয়ার পর অসংখ্য পাঠক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁদের সহায়তায় মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল। ওর মা জানান, আগে দাঁড়াতেই পারত না। এখন ওয়াকারে ভর করে হাঁটতে পারে। কিন্তু থেরাপি বন্ধ হওয়ায় হাঁটার শক্তিও হারিয়ে ফেলছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে চার মাস ধরে ফিজিওথেরাপিস্টদের কাজ প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে যে রোগীদের ফিজিওথেরাপির সেবা নেওয়া জরুরি, তারা সেটা নিতে পারছে না। ফলে বেড়েছে ভোগান্তি।
শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীই নয়, ক্যানসার, স্ট্রোক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগীর এ সেবাটা প্রয়োজন হয়। এই সেবার চাহিদা বাড়লেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ফিজিওথেরাপিস্ট বেসরকারিভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
উত্তরার ফিট অ্যান্ড ফাইন ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক জয়নাল আবেদীন জানান, তাঁর সেন্টার ও সেন্টারের মাধ্যমে যে হোম সার্ভিস দেওয়া হতো, তা মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বন্ধ রেখেছেন। কারণ, ফিজিওথেরাপিস্টদের রোগীর একদম কাছাকাছি যেতে হয়। ফলে করোনার সময়ে ঝুঁকিটা বেশি।
অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য সমন্বিত সেবার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অকুপেশনাল ও ফিজিওথেরাপি সেবা। রাজধানীর পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ২০১৪ সাল থেকে অটিজম ও স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের (১১ থেকে যেকোনো বয়সী) স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে কাজ করছে। বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সাজিদা রহমানের আরেকটি পরিচয়, তিনি ২৬ বছর বয়সী অটিস্টিক সিয়ামুল করিমের মা। ছেলে এ লেভেল সম্পন্ন করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পর্যটনের ডিউটি ফ্রি শপে কাজ করেন। তবে এখন কাজ বন্ধ করে বাসায় বসে অনলাইনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
সাজিদা রহমান বলেন, সেন্টারের প্রায় ৬০ জনের জন্য অনলাইনে ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তিদের অকুপেশনাল ও ফিজিওথেরাপি বন্ধ রাখার কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বাবার বয়স ৮৫। শরীরে ক্যাথাটার লাগানো। পাইপের সাহায্যে খাওয়াতে হয়। করোনার আগে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বাসায় আসতেন। এই প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট একাই যে কাজটি করতেন, আমরা পরিবারের তিনজন মিলেও সেভাবে থেরাপি দিতে পারছি না।’
এদিকে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড বা সিআরপিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে। সিআরপির দেওয়া তথ্য বলছে, গত মার্চে সেবা নিতে আসা নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৪৪৬। এপ্রিলে তা কমে আসে ৩২১ জনে। মে মাসে একজন নতুন রোগীও চিকিৎসা নিতে আসেনি। তবে জুন মাসে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৮৪৪। চার মাসের হিসাবে মোট রোগী এসেছে ১৩ হাজার ৬১১ জন। অথচ গত বছর এই একই সময়ে রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩৪ হাজার।
সিআরপির নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ফিজিওথেরাপির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগে থেকেই যেসব রোগী এ সেবা নিচ্ছিল, করোনার কারণে তারাও দীর্ঘ সময় তা নিতে পারছে না। ফলে রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় ফিজিওথেরাপির চাহিদাও বাড়ছে। অটিস্টিকসহ অন্য যাদের এ সেবা নিতেই হয়, তাদের অবস্থাও খারাপ হয়েছে।
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমাদের সেন্টারে ফিজিওথেরাপিস্ট যাঁরা আছেন, তাঁদের সুরক্ষার দিকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া হচ্ছে। আর কোভিডের কারণে উন্নত বিশ্বে একধরনের বিশেষ থেরাপি চালু হয়েছে। আমরাও সামনের সপ্তাহ থেকে সাভার এবং মিরপুর কেন্দ্রে কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ থেরাপি চালু করতে যাচ্ছি।’