করোনার সংক্রমণ বাড়লেও রোগী হাসপাতালমুখী কম
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়লেও ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী কমছে। এমনকি অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরাও সেবা নিতে হাসপাতালে কম যাচ্ছেন। কোনো কোনো হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক, কোথাও বা তারও কম। শয্যার সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে দেশের ছয়টি বড় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব জরুরি না হলে এখন রোগীরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না।
তবে অসুস্থ হওয়ার পরও মানুষ কেন হাসপাতালে কম যাচ্ছেন, এর সুনির্দিষ্ট কারণ কেউ বলতে পারছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি একধরনের আস্থাহীনতাও এমন পরিস্থিতি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, রোগীরা হাসপাতালে গেলে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না, এটা সত্য। আবার করোনার সংক্রমণ না কমায় হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে জনগণের মধ্যে আতঙ্কও রয়েছে। সংক্রমণের ভয়ে চিকিৎসকদের অনেকেও হাসপাতালে যাচ্ছেন না। আস্থাহীনতা, সেবা না পাওয়া এবং ভয়—সব মিলিয়েই হাসপাতালগুলোতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার গৃহিণী সাহানা সাত্তারের (৫৬) উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে। চার বছর ধরে তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য প্রতি মাসে একবার মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যেতেন। গত মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আর হাসপাতালে যাননি। এর কারণ হিসেবে বললেন, ‘করোনার কারণে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে হাসপাতালে যাইনি। আগের ওষুধগুলোই এখনো খেয়ে যাচ্ছি।’
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। প্রতিটি হাসপাতালেই বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা ও অন্তর্বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ কম।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১০ দিন ধরে ৩৫০ থেকে ৪৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাভাবিক সময়ে দিনে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার রোগী হতো। হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ৮৩৫ জন (১৩৫ জন করোনা রোগী)। স্বাভাবিক সময়ে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ রোগী নিয়মিত ভর্তি থাকত।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৭ জুন থেকে হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়েছে। ২০০ শয্যার করোনা ইউনিটে গতকাল ১৩৫ জন রোগী ভর্তি ছিল। ২৭ জুনের আগে বহির্বিভাগে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী হচ্ছিল। করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর সেটি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এই হাসপাতালের সহকারী পরিচালক কে এম মামুন মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, বহির্বিভাগে রোগী অনেক কমে গেছে। আগে দৈনিক গড়ে আড়াই হাজার রোগী হতো। করোনা ইউনিট চালুর পর বহির্বিভাগে রোগী একদমই কমে গেছে। একদম বাধ্য না হলে রোগীরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ চিকিৎসা পরামর্শ নিতে আসতেন। এখন দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী আসছেন। গতকাল হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ১ হাজার ১০০ জন। স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকত।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর জনমনে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় রোগীর সংখ্যা কমে গেছে।
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন ৩২৩ জন। স্বাভাবিক সময়ে এই হাসপাতালে ৭৫০ থেকে ৮০০ রোগী ভর্তি থাকতেন। করোনার আগে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতেন। গতকাল বহির্বিভাগে ৪০০ রোগী সেবা নিয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, করোনাভীতির কারণে মানুষ হাসপাতালে আসা কমিয়েছে। অনেক চিকিৎসক এখন মুঠোফোন ও অনলাইনে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে আগে দৈনিক ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী ভর্তি থাকত। গতকাল ছিল ৫৪৫ জন। অন্য হাসপাতালগুলোর তুলনায় এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি। গত সোমবার এই হাসপাতালে ১ হাজার ৫৫ জন রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন। তবে সেটিও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ উন নবী প্রথম আলোকে বলেন, মে মাসের শেষ দিকে (ঈদের পর থেকে) বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি কোভিড-১৯ রোগীদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক আছমাতুন নেসা মনে করেন, হাসপাতালে এলে করোনার সংক্রমণ হতে পারে—এমন আতঙ্কে খুব জরুরি না হলে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন না। এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
চিকিৎসা না করালেই নয় এমন রোগী ছাড়া কেউ হাসপাতালে আসছেন না বলে জানান বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বাকির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা আতঙ্কের পাশাপাশি হাসপাতালে আসার ক্ষেত্রে পরিবহন সমস্যাও রয়েছে। আগে হাসপাতালে দৈনিক আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার রোগী সেবা নিতেন। এখন ৭০০ থেকে ৭৫০ জন সেবা নিতে আসছেন।
৭১ শতাংশ কোভিড শয্যাই ফাঁকা
শুধু নন-কোভিড রোগীরাই নন, কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের শয্যাও ফাঁকা থাকছে। অধিকাংশ করোনা আক্রান্ত রোগী বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ১৪ হাজার ৭৭৫টি। গতকাল এসব শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন ৪ হাজার ২২১ জন। অর্থাৎ, মোট শয্যার ৭১ দশমিক ৪৪ শতাংশই ফাঁকা থাকছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, শুরু থেকেই ট্রায়াজের (উপসর্গ দেখে কোভিড সন্দেহভাজন রোগী আলাদা করা) মাধ্যমে সব হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড দুই ধরনের রোগীর সেবা দিলে পরিস্থিতি এমন হতো না। সেবাগ্রহীতা ও সেবাদাতা দুই পক্ষের মধ্যেই আতঙ্ক কাজ করছে। খুব শিগগির এই সংকট দূর হবে না। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।