বন্যায় হুমকিতে বীজতলা-ফসল, বাড়ছে কৃষকের দুশ্চিন্তা
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চড়ুয়াপাড়া গ্রামের বকুল মিয়া এবার দেড় একর জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন। এর আগে বোরো ধান করে ফলন ভালো হলেও ন্যায্যমূল্য পাননি। পাট চাষে খরচ কম, তাই আশায় ছিলেন দাম যা–ই হোক অন্তত লোকসান হবে না। আর ১০–১৫ দিন পর পাট কাটা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু বকুল মিয়ার ভাষায়, ‘আগাম বন্যা আসি হামার এই বছরের শেষ স্বপ্নটাও ডুবি গেইল।’
তবে দেশের অন্য এলাকায় এখনো বন্যায় ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। সরকারি হিসাবে, বন্যায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়েছে। বাকি ১ লাখ ৮৬ হেক্টর এখনো অরক্ষিত আছে। তবে ভয় এখন বন্যার পরবর্তী ধাক্কা নিয়ে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বৃষ্টি বেড়ে পানি বাড়লে দেশের যে এলাকাগুলো ডুববে, তার বড় অংশজুড়ে আছে আমনের বীজতলা, পাকতে শুরু করা আউশ আর প্রায় পরিণত হয়ে ওঠা পাট। আমনের চারা ও আউশ তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি দিন পানির নিচে থাকলে নষ্ট হয়ে যায়। পাট পাঁচ থেকে সাত দিন পানি সইতে পারে। এর চেয়ে বেশি সময় বন্যা থাকলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী দুই দিন পানি আরও কমবে। তারপর বৃষ্টি বেড়ে বন্যা বাড়তে পারে। দেশের ৪০ শতাংশ জেলার নিম্নাঞ্চল ওই বন্যায় প্লাবিত হতে পারে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোরোতে ভালো দাম না পাওয়া, করোনার কারণে যোগাযোগব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হাটে গিয়ে ধান বিক্রি করতে না পারা এবং সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছিল, তার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সরকার বা উন্নয়ন সংস্থা কেউই এখন পর্যন্ত কৃষককে কোনো সহায়তা দেয়নি। এ পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা আবারও বন্যার ঝুঁকিতে পড়লেন।
>ক্ষতির মুখে কৃষক
আমনের বীজতলা, পাট, সবজি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি
উঁচু জায়গায় আমনের বীজতলা তৈরির পরামর্শ
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফসলের দাম না পাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে একের পর এক দুর্যোগ। ফলে কৃষক সমাজ আর্থিকভাবে যথেষ্ঠ ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমনে তাদের জন্য সরকার বিশেষ সহায়তা না দিলে এই ধানের মৌসুমে কৃষকের পক্ষে উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। আর পরবর্তী বোরোতে তারা ধান উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত ২৭ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যার পরবর্তী ধাপে পানি আরও বেশি হতে পারে। মৌসুমি বায়ু এরই মধ্যে বেশ শক্তিশালী হয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশের উজানে অবস্থান করছে। দু–এক দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টি ঝরিয়ে তা বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টির বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যার পরবর্তী ঢল সম্ভবত আসতে যাচ্ছে। ফলে আমাদের সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে।’
আবহাওয়া দপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে কৃষি আবহাওয়াবিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই দুই সংস্থার যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমনের বীজতলা নষ্ট হলে পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যাসহিষ্ণু জাতের চারা উৎপাদন করতে হবে। এ জন্য বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত ব্রী ধান ৫১ ও ৫২ এবং বিনা–১১ ও ১২ জাতের ধানের বীজতলা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মুঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব জেলাতেই উঁচু জায়গায় আমনের বীজতলা তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আবার উঁচু জমিতে আমরা নিজেদের উদ্যোগেও চারা রোপণের প্রস্তুতি রেখেছি।’
কোন ফসল মাঠে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, আমন মৌসুমের জন্য ২ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আউশের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এরই মধ্যে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এসব পাটের বেশির ভাগই প্রায় পরিণত অবস্থায় আছে। আগামী ১ সপ্তাহ থেকে ১২ দিনের মধ্যে তা কাটা যাবে। এ বছর ৮২ লাখ ৪২ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যায় এরই মধ্যে জামালপুর, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও রাজবাড়ী এলাকার নিম্নাঞ্চলের পাট সাত–আট দিন ধরে পানির নিচে আছে। এক সপ্তাহের বেশি পানির নিচে থাকলে তা নষ্ট হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কৃষক মো. বাদল হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সব পাট আর সবজি এক সপ্তাহ ধরে পানির নিচে। এবার পাট আর সবজি ঘরে তুলতে পারব না। এখন পানি নেমে গেলে সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে আমন করা যাবে। কিন্তু আমাদের কী ক্ষতি হলো তার খোঁজই কেউ নেয় না, সাহায্য তো পরের কথা।’