করোনার সংক্রমণ বাড়ছেই, শিগগিরই কমার লক্ষণ নেই
চতুর্থ মাসে এসেও দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের রেখা ঊর্ধ্বমুখী। আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু, পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার সবই বাড়ছে। শিগগির সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কিছু নির্দেশক থেকে বোঝা যায় একটি দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশকের বিপরীতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। ফলে সংক্রমণের প্রকৃত ব্যাপকতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা করা কঠিন। তবে যতটুকু তথ্য আছে, তার সঙ্গে বাস্তব প্রেক্ষাপট মিলিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
কোনো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কি না, তা কীভাবে বোঝা যাবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, তাত্ত্বিকভাবে এটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ইফেক্টিভ রিপ্রোডাকশন নাম্বার (প্রতিটি প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে পরবর্তী সংক্রমণের সংখ্যা) দেখা। এ সংখ্যা অন্তত দুই সপ্তাহ ১-এর নিচে থাকলে বলা যায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে এবং তা কমতির দিকে।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ–সংক্রান্ত কোনো গবেষণা বা তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বার্তা সংস্থা এএফপির এক খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৪ জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশে সংক্রমণের রিপ্রোডাকশন সংখ্যা ১–এর ওপরে। ১ দশমিক ১৭, যা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব (আউটব্র্যাক) নির্দেশ করে।
এর বাইরে বিকল্প হিসেবে আরও কিছু নির্দেশকের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, যেগুলোর সব না হলেও কিছু নির্দেশক ব্যবহার করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না, সেটা বোঝা যায়। গত ১২ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে নির্দেশকগুলোর কথা বলেছে, সেগুলো হলো সংক্রমণের সর্বশেষ চূড়ান্ত পর্যায় (পিক) থেকে টানা তিন সপ্তাহে যদি রোগী শনাক্ত ও সন্দেহভাজন অন্তত ৫০ শতাংশ কমে আসে; অন্তত দুই সপ্তাহ যদি পরীক্ষা করা নমুনার ৫ শতাংশের কম পজিটিভ বা আক্রান্ত হিসাবে শনাক্ত হয়; অন্তত ৮০ শতাংশ সংক্রমণ যদি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে হয়; তিন সপ্তাহ ধরে যদি মৃত্যু এবং সন্দেহজনক মৃত্যু কমে আসে; রোগী ভর্তি এবং আইসিইউতে নেওয়া রোগীর সংখ্যা যদি দুই সপ্তাহ ধরে কমতির দিকে থাকে এবং নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুহার যদি কমে আসে, তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ–ও বলেছে, সব দেশে এসব তথ্য যথাযথভাবে না–ও থাকতে পারে। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যায় না, তিনটি নির্দেশকের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, দেশে সংক্রমণ এখনো বাড়তির দিকে, শনাক্তের হারও অনেক বেশি, মৃত্যু এবং সন্দেহভাজন মৃত্যুও বাড়ছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সংক্রমণের পিকে (চূড়ায়) পৌঁছেছে কি না, বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা চীনের বিশেষজ্ঞরা গত রোববার এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছেছে কি না, সেটা বলা কঠিন। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং পরিকল্পিত উপায়ে লকডাউনসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় পজিটিভ বা আক্রান্ত পাওয়ায় হার অনেক বেশি এবং সে হার বাড়তির দিকেই আছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পরিমাণ পরীক্ষার কথা বলেছে, বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকের কিছু বেশি পরীক্ষা হচ্ছে। এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরই পরীক্ষা হচ্ছে। গণহারে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে দেশে সংক্রমণের ব্যাপকতা আসলে কতটুকু, তা অনুমান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রয়োজনের চেয়ে কম পরীক্ষা হলেও দেশে আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে অনেক বেশি। গত দুই সপ্তাহে আক্রান্ত শনাক্তের হার প্রায় ২২ শতাংশ। সংক্রমণের প্রথম মাসে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩২, দ্বিতীয় মাসে ১১ দশমিক ৫৮ এবং তৃতীয় মাসে শনাক্তের হার ছিল ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
দেশে এখনো করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং সন্দেহভাজন বা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু কমছে না। দুটোই বরং বাড়ছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দিনে গড়ে ৪০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। ২ জুনের আগ পর্যন্ত যা ছিল ৩০–এর নিচে।
একই ভাবে সন্দেহভাজন মৃত্যুও বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) একটি প্রকল্প বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) এ ধরনের মৃত্যুর হিসাব রাখছে। ১৯ জুন তারা জানায়, তিন সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে ১৭৯ জনের এমন মৃত্যু হয়েছে, যা এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা কম হচ্ছে বিধায় সংক্রমণের ব্যাপকতা আসলে কতটুকু, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে মনে হচ্ছে এখনো সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। আরও সপ্তাহখানেক দেখে পরিস্থিতি বোঝা যাবে। তিনি বলেন, এখনই জোরেশোরে উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবাই সতর্কতা অবলম্বন করলে কিছুদিন পর থেকে সংক্রমণ রেখা নিচের দিকে নামবে।
আবারও সংক্রমণের শীর্ষ দশে বাংলাদেশ
গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা) দেশে আরও ৩ হাজার ৪৬২ জন নতুন আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৬৬০। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৩৭ জন। এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৫৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর মোট ৪৯ হাজার ৬৬৬ জন সুস্থ হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা গতকাল সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার এসব হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ২১৫ দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বেড়েছে, এমন দেশের তালিকায় গতকাল বাংলাদেশ আবার দশম স্থানে উঠে এসেছে। এর আগের দিন ছিল ১১তম। আর ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ নতুন রোগী শনাক্ত হওয়া শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ নবম।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা ও উদ্যোগ আছে। কিন্তু এখনো সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণের হার স্থিতিশীল হয়ে নিম্নমুখী হলে তখন বলা যাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।