ঘূর্ণিঝড়ের পর আগাম বন্যার শঙ্কা

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

গত বছরই দেশের বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এর আগের সব কটি রেকর্ড ভেঙেছে। এবার তেমন কিছু হবে কি হবে না, সেই পূর্বাভাস এখনো পাওয়া না গেলেও বন্যা এবার আগেভাগে শুরু হতে পারে। এরই মধ্যে দেশের তিনটি বড় নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও তিস্তার পানি দুই কূল ছাপিয়ে যেতে পারে। বসতি এলাকায় ঢুকে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে বন্যা শুরু হতে পারে।

সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এই পূর্বাভাস দিয়েছে। একই সঙ্গে সংস্থাটি বলছে, জুলাইয়ের শুরুতে পদ্মা অববাহিকা ও চট্টগ্রামের নদ-নদীগুলোর দুই পারের নিম্নাঞ্চলে বন্যা শুরু হতে পারে। একেকটি এলাকার বন্যার পানি কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকতে পারে। তারপর পানি নেমে গিয়ে আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরেক দফা বন্যা হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে যেমন বৃষ্টি বেড়ে গেছে, তেমনি উজানেও অস্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে। ওই বৃষ্টি এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের নদী অববাহিকাগুলোতে চলে এসে বন্যা দেখা দিতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১০১টি পয়েন্টের মধ্যে ৬৮টি পয়েন্টেই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে গত শনিবার ভোরে পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল রোববার অবশ্য সে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

নদী ও বন্যা নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, সাধারণত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রথম দফার স্বাভাবিক বন্যা হয়। এবার তা জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে।

আগেভাগেই এই বন্যা শুরু হাওয়াকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বড় বিপদের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, গত মে মাসটা ঘূর্ণিঝড়ের তোপের মুখে কেটেছে। আর জুনের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাবে একের পর এক বন্যার ধাক্কা সামলাতে। এই ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা বেড়ে যাওয়াকে বিশেষজ্ঞরা একই সূত্রে গাঁথছেন। বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তাঁরা বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত মনে করেন, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। বিশেষ করে আবহাওয়া চরম আকার ধারণ করছে। টানা বৃষ্টি বেশি হয়ে হঠাৎ করে বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার দ্রুত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়ে ভূখণ্ডে আঘাত করা বেড়ে গেছে। বছরের পুরো সময় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি আরও বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

>

এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও তিস্তাপারে বন্যা হতে পারে
বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বাড়ায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার পরিমাণ বাড়ছে

গত শুক্রবার ভারতের আর্থ অবজারভেটরি মন্ত্রণালয় থেকে ‘ভারত মহাসাগরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-২০২০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেশি বাড়ছে। ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, এ সময়ের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ফলে এখানে ঘূর্ণিঝড় বেশি হচ্ছে আর মৌসুমি বায়ুতে জলীয় বাষ্প বেড়ে গেছে। ২০৪০ সালের মধ্যে এই তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি আর এই শতাব্দীর মধ্যে ৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে।

প্রতিবেদনটির ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার পর্বত উন্নয়নবিষয়ক সংগঠন ইসিমুডের মহাপরিচালক ডেভিড মোলডেন প্রথম আলোকে বলেন, উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টি বাড়ছে, অন্যদিকে হিন্দুকুশ ও হিমালয় পর্বতশ্রেণি এলাকার বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বন্যার পানি বাড়ছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, এ বছর মৌসুমি বায়ু স্বাভাবিকের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ফলে ১৩ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশেই কমবেশি টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামে আগামী ১০ দিনে ৫০০ থেকে ১ হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর বাঁধ স্বাভাবিক বন্যা মোকাবিলার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। পানিচক্রের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও অবকাঠামো কীভাবে টিকে থাকবে, সেই পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে।’