করোনারোধে ব্যবহৃত সুরক্ষাসামগ্রীতে ঝুঁকি
স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কোভিড-১৯ হয়েছে। চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে, সঙ্গনিরোধের নিয়ম মেনে। সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস আর গগলস পরছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও এসব ব্যবহার করছেন, বাইরে বেরোলে পরছেন সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই।
এ বাসার সবাই এসব সুরক্ষাসরঞ্জাম ব্যবহারের পর একটি পলিথিনের ব্যাগে ভরে রাখেন। এটুকু পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর নিয়মগুলো ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে। কিন্তু তারপর এই ব্যাগ তাঁরা বাসার অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে একত্রে ময়লার ভ্যানে তুলে দিচ্ছেন।
এই পরিবার একা নয়; ঢাকা মহানগরীর প্রায় সব পরিবারই তাঁদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো এভাবে গৃহস্থালি বর্জ্যের ভ্যানে ফেলছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এসব বর্জ্য ভ্যানে তুলে নিয়ে যান প্রায় ১২ হাজার বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁরা আবর্জনা নাড়াঘাঁটা করেন, মাস্ক-গ্লাভস-গগলস-পিপিইগুলোর সরাসরি সংস্পর্শে আসেন।
তাঁদের কোনো সুরক্ষাসামগ্রী নেই। সংক্রমণের প্রত্যক্ষ ঝুঁকিতে থাকা এই কর্মীরা প্রতিদিন নগরীর প্রায় সব কটি বাড়িতে যাচ্ছেন। তাঁরা এলাকার জন্য নির্ধারিত ময়লাঘর আর কনটেইনারে বর্জ্য রেখে যাওয়ার পর করপোরেশনের কর্মীরা সেগুলো নিয়ে ফেলেন নগরীর দুই প্রান্তে মাতুয়াইল ও আমিনবাজারের ভাগাড়ে।
সেখানে মহানগরীর দেড় কোটির বেশি বাসিন্দার নিত্যদিনের মাছ-মাংস-সবজির আবর্জনা আর আরও হাজারো বর্জ্যের সঙ্গে পড়ে থেকে গণসংক্রমণের ঝুঁকি ছড়াচ্ছে তাঁদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বাসাবাড়ির বর্জ্যে ব্যবহৃত সুরক্ষাসামগ্রীগুলো মিলেমিশে যাওয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। করপোরেশন এখন এগুলো আলাদাভাবে নিকাশের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।
>ব্যবহৃত মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই বাসাবাড়ির আবর্জনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার
ফেলা হচ্ছে রাস্তাঘাটেও
হাসপাতালের বর্জ্য শোধন নিয়ে প্রশ্ন
এয়ার কমোডর বদরুল আমিন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, প্রায় সবাই এখন মাস্ক, গ্লাভস ও গগলস ব্যবহার করছেন। করপোরেশন জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে সাতটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা কনটেইনার বসিয়েছে। বিজ্ঞপ্তি সেঁটে বলেছে, নাগরিকেরা যেন সুরক্ষাসামগ্রীর বর্জ্য আলাদা পাত্রে ভরে সেখানে ফেলেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেগুলো আলাদাভাবে নেবেন।
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, কমোডর এম সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মহানগরীর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশের মাধ্যমে বাসাবাড়ির সুরক্ষা বর্জ্য নিকাশের ব্যবস্থা করছেন। এখন থেকে নাগরিকেরা তাঁদের ব্যবহৃত মাস্ক-গ্লাভস ও অন্যান্য সামগ্রী আলাদা করে রাখবেন। প্রিজম বাসা থেকে সেগুলো নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, করোনার এই সময়ে সুরক্ষাসামগ্রীর বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মেশার ঝুঁকি সম্পর্কে ১৪ জুন অধিদপ্তর গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে করপোরেশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সুরক্ষা বর্জ্য আলাদাভাবে নিষ্কাষণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) গত ২৬ মার্চ থেকে ২৬ এপ্রিল সময়ে দেশব্যাপী ১ হাজার ৭০০ জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি জরিপ করেছে। সেটা বলছে, ওই এক মাসে দেশে মাস্ক, গ্লাভসসহ মোট প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে সার্জিক্যাল গ্লাভস ও মাস্ক ছিল দুই হাজার টনের কাছাকাছি।
স্থপতি ইকবাল হাবীবও গণসংক্রমণের ঝুঁকির কথা বলছেন। তিনি বলছেন, নিকাশের যথাযথ ব্যবস্থা না করে একই ভাগাড়ে গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে এসব বর্জ্য ফেলার ঝুঁকিটা অনেক বড়।
হাসপাতালের বর্জ্য
করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগী কমেছে। আগে ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ টন মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হতো। এখন তা হচ্ছে মাত্র ৩ থেকে ৪ টন।
কিন্তু মহানগরীর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত অন্তত পাঁচজন প্রথম আলোকে বলেছেন, হাতে গোনা দু-একটি বাদে হাসপাতালগুলো যথাযথ পদ্ধতিতে বর্জ্য রাখছে না। নিয়ম অনুযায়ী এসব বর্জ্য অটোক্লাভ যন্ত্রে জীবাণুমুক্ত করে তারপর সুরক্ষা ব্যাগে (বায়োসেফটি ব্যাগ) ভরে রাখার কথা।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, সারা দেশে বহু করোনারোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁরা প্রত্যেকে মাস্ক-গ্লাভস ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছেন। এগুলো ঘরের ভেতরে যথাযথভাবে রাখা না হলে কিংবা গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে একত্রে একই ভাগাড়ে ফেললে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি হবে বিরাট। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেকোনো অবহেলা ঘটলে গণসংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।