সাংসদ পাপুলকে জেলহাজতে পাঠাল কুয়েত
মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক বাংলাদেশের সাংসদ কাজী শহিদ ইসলামকে আট দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে কুয়েতের কর্তৃপক্ষ। কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দেশটির বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সাংসদকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। এ ছাড়া ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে বিপুল অর্থ যে কাজী শহিদ পাচার করেছেন, তার প্রমাণ পেয়েছে কুয়েতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কুয়েতে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক সাংসদ কাজী শহীদ ইসলাম ওরফে পাপুল, তাঁর স্ত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ সেলিনা ইসলাম, তাঁদের মেয়ে এবং সেলিনা ইসলামের বোনের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আজ বুধবার এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
কুয়েতের সরকারি বার্তা সংস্থা কুনা, ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস ও কুয়েত টাইমস এবং আরবি দৈনিক আল রাইয়ের গত কয়েক দিনের খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সাংসদের আটকের ঘটনা দেশটির রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সাংসদের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনায় মদদ দেওয়ায় দেশটির রাজনীতিবিদ ও সরকারী কর্মকর্তাদের নাম এসেছে। ফলে কুয়েতের মন্ত্রিসভার বৈঠক, পার্লামেন্টের আলোচনার পাশাপাশি টুইট আর ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুয়েতের নাগরিকেরা এ বিষয়ে কথা বলছেন। আরব টাইমসের খবর, কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন বাংলাদেশের এই সাংসদকে ডিটেনশনে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
কুয়েতের কূটনীতিক ও ব্যবসায়িক সূত্রগুলোর সঙ্গে বুধবার কথা বলে জানা গেছে, পাবলিক প্রসিকিউশন গতকাল মঙ্গলবার সাংসদ কাজী শহিদকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
কুয়েতের অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মরিয়ম আল আকিলের বরাত দিয়ে সেখানকার গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সরকারের জনশক্তি কর্তৃপক্ষের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে তিন মাসের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে। কুয়েতে মানব পাচারের বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক প্রসিকিউশন ওই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করে। জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুয়েত সরকার জনশক্তি দপ্তরের ওই কর্মকর্তাকে তিন মাসের জন্য বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুদকের তদন্ত ও চিঠি
গত ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সাংসদ কাজী শহিদের মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচার নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বুধবার কথা বলে জানা গেছে, মূলত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ কাজী শহীদ ইসলামের বিষয়ে তদন্তে নামে দুদক। এরপর থেকে সাংসদের বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।
বুধবার সন্ধ্যায় দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, কাজী শহিদ ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ সেলিনা ইসলাম, তাঁদের মেয়ে কাজী ওয়াফা ইসলাম এবং সেলিনা ইসলামের ছোট বোন জেসমিন আক্তারের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুদক। তাঁদের মধ্যে এ মুহূর্তে কুয়েতে আটক কাজী শহিদ দেশে আসার পর তাঁর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞাটি কার্যকর হবে।
দুই সাংসদ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা যাতে বিদেশ যেতে না পারেন, এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনের সই করা একটি চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখা ও বহির্গমন বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে দুদক কাজী শহিদ ইসলাম এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের করের বিষয়ে তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া সাংসদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের তথ্য চেয়ে ৯ জুন দুদক একটি চিঠি দিয়েছিল।
কর্মীদের যত অভিযোগ
কুয়েতে কাজী শহিদ দুই বছর আগে নিয়ে যাওয়া অন্তত তিন শ-জনকে আকামা বা কাজের অনুমতিপত্র দিতে পারেননি। তাঁরা কাজ করতেন কাজী শহিদের প্রতিষ্ঠান মারাফিয়া কুয়েতিয়ায়। অথচ তাঁদের নিয়োগপত্র ছিল অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এমন চারজন এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁদের প্রতিশ্রুত বেতন তো দেওয়া হতোই না। উল্টো বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়া হতো। এরপর ছিল মারধর।
এ মুহূর্তে কুয়েতে থাকা বাংলাদেশের ওই চার কর্মী জানান, কুয়েতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে যে ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই সাংসদের কর্মী হলেও তাঁদের নিয়োগ ছিল অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে। সব মিলিয়ে তাঁদের জীবন এতটাই দুর্বিষহ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, যার দরুন তাঁরা কুয়েত সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিবন্ধন করে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন।