মালতী ফুলের নন্দনকানন
গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে ঢাকায় ফিরছি। এরই মধ্যে একটি খামারবাড়ি দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ এল। আমরা যেখানে আছি, সেখান থেকে বেশি দূরে নয়। তাই সম্মতি জানাতে দেরি হলো না। এবারের শেষ জ্যৈষ্ঠেও যেন প্রকৃতিতে বর্ষার সুর। মাথার ওপরে মেঘ–বৃষ্টি–রোদ। তার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে জুটেছে ঘামঝরানো তাপ।
মাওনা চৌরাস্তায় এসে রীতিমতো যানজটে পড়তে হলো। মানুষ, গাড়ি, দোকানপাট—কোনো কিছুর কমতি নেই। সব ঢালাওভাবে চলছে। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তো মাস্ক ছাড়াই ঘোরাফেরা করছে। মানুষের এই কোলাহলমুখর যাপিত জীবন দেখে কে বলবে, মারাত্মক ছোঁয়াচে করোনার ভয়ে দেশ কাঁপছে। করোনাক্রান্তির কোনো ছাপই নেই।
৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম শ্রীপুরের সিংগারদিঘী গ্রামে। গ্রামের পথ অবশ্য অপেক্ষাকৃত নির্জন। নির্জন এই নিসর্গদৃশ্যে গৃহস্থ বাড়ির সবজির মাচা আর বিচিত্র উদ্ভিদের ঠাসবুনোট। গ্রামের এমন দৃশ্য সব সময়ই মন-প্রাণে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। পথের দুপাশ সবুজে মোড়ানো। সবুজ মানে একেবারে ধোয়ামোছা পরিষ্কার সবুজ।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম মূল ফটকেই অপেক্ষা করছিলেন। বাড়িটি মূলত ডেকো ইসো নামে একটি প্রতিষ্ঠানের। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল নবীন লিচু আর আমবাগান। জানা গেল, এবার চায়না-৩ জাতের ৮ হাজার লিচু ফলেছে এই বাগানে। গাছে গাছে কাঁচা-মিঠে আম ঝুলছে। হাঁটাপথের দুপাশে ফুটেছে দুই রঙের নয়নতারা ফুল।
এ পথেই মিলল দৃষ্টিনন্দন ড্রাগন ফলের বাগান। এই বাগানের উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক হলেও নান্দনিকতা তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পাশের এক টুকরো বাগানে পাওয়া গেল বিচিত্র রঙের জারবেরা ফুল। সারা দেশে এখন এই ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। উজ্জ্বল নজর কাড়ে সহজেই। ঘরের শোভা বাড়াতেও এদের জুড়ি নেই।
জারবেরার সম্মোহ থেকে দৃষ্টি সরাতেই চোখে পড়ল একটি সুসজ্জিত অর্কিডঘর। কিন্তু সেই আলো–ঝলমল অর্কিডঘরে ঢোকার আগেই মায়ার বাঁধনে জড়াল প্রিয় মালতীলতা। এই নিভৃত গ্রামে এমন যত্নে রাখা আর্চ ভরতি মালতী দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়? কয়েকগুচ্ছ শুভ্র মালতী তার কোমল পাপড়ি মেলে ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচনায় অন্তত সতেরোবার এ ফুলের কথা উল্লেখ করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘ওই মালতীলতা দোলে/ পিয়ালতরুর কোলে, পূব–হাওয়াতে।’
এবার রূপসী অর্কিডের সৌন্দর্যে অবগাহনের পালা। বর্ণবৈচিত্র্য আর দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফুটনের জন্য অর্কিড বেশ জনপ্রিয়। ছোট্ট ঘরটি আলো করে ফুটেছে আট প্রজাতির অর্কিড। তাতে ডেনড্রোবিয়াম জাতের ফুলই বেশি। ভ্যান্ডা জাতের কয়েকটি আবাদিত রকমফেরও চোখে পড়ল। তবে আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অজস্র অর্কিডের ভিড়ে এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তবু ফুলের প্রতি এমন অনুরাগের জন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামগুলো ঘুমিয়ে পড়বে। নন্দনকানন পেছনে ফেলে আমরা আবার ফিরে আসি পুরোনো পথে, ফেলে আসা শহরের দিকে।