২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হাসপাতালে ভর্তি মিলছে না, অসহায় সাধারণ রোগীরা

চাঁদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিন দিন আগে খাদিজা আক্তারের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর বাচ্চাটা সুস্থ থাকলেও খাদিজা আক্তার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা। শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ার পর চাঁদপুর থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে খাদিজা আক্তারকে ঢাকার কিডনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শুক্রবার ভোররাত চারটায় খাদিজাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার কিডনি হাসপাতালে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিট খালি না থাকার কথা বলে খাদিজাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুপারিশ করে। পরে শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খাদিজাকে নিয়ে আসা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পর জানিয়ে দেওয়া হয়, খাদিজার ডায়ালাইসিস দরকার। কিন্তু হাসপাতালে খাদিজাকে ভর্তি করা সম্ভব নয়। 

শুক্রবার বেলা ১১টার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যন্ত্রণায় কাতর খাদিজা চুপচাপ বসে ছিলেন।

খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কচুয়ার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে আমার বাচ্চা হয়। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে আমার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। আমার শরীর খুবই খারাপ। নিজে বাঁচার জন্য তিন দিনের দুধের শিশু অন্যের কাছে রেখে আমি ও আমার পরিবার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছি। কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছি না। অথচ আমার কিডনিতে খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে। ডাক্তার বলতেছে, আমার ডায়ালাইসিস দরকার। কিন্তু কোনো হাসপাতাল আমাকে ভর্তি করতেছে না।’

ক্যানসারে আক্রান্ত বাবুল মিয়ার শরীর খুবই খারাপ, কথা বলতে পারেন না, অচেতন প্রায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়ায় তাঁকে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান
ক্যানসারে আক্রান্ত বাবুল মিয়ার শরীর খুবই খারাপ, কথা বলতে পারেন না, অচেতন প্রায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়ায় তাঁকে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান

স্ত্রীকে কোথাও ভর্তি করাতে না পেরে খাদিজার স্বামী জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর আগে কিডনির কোনো জটিলতা ছিল না। সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর প্রস্রাবের রাস্তা বন্ধ। এখন ডাক্তার বলছেন, কিডনিতে সমস্যা হয়ে গেছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছি। কিন্তু কোথাও আমি আমার স্ত্রীকে ভর্তি করাতে পারছি না।’

বাড়ি ফিরে গেছেন ফরিদ

ক্যানসরে আক্রান্ত ৫৫ বছর বয়সী ফরিদ মিয়াকে শুক্রবার সকালে ঢাকার মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। করোনার নমুনা পরীক্ষা না করানো থাকায় তাঁকে ভর্তি না করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলা হয়। পরে ফরিদ মিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সকাল নয়টার দিকে নিয়ে আসেন তাঁর ছেলে ইব্রাহীম। ফরিদ মিয়া ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না।


ইব্রাহীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আব্বার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। যন্ত্রণায় চিৎকার–চেঁচামেচি করেছেন। আব্বাকে ক্যানসার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় ডাক্তাররা বলেছেন। আমি আব্বাকে নিয়ে মহাখালীর ক্যানসার হাসপাতালে গিয়েছি। কিন্তু করোনার পরীক্ষা না করানোয় আব্বাকে ভর্তি করবে না বলে হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে। পরে আমরা এলাম ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু এখানেও আমার আব্বা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। করোনার পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি করবে না। তাই বাধ্য হয়ে আমার আব্বাকে আবার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। যদি করোনার পরীক্ষা করাতে পারি, তাহলে আব্বাকে ক্যানসার হাসপাতালে নিয়ে যাব।’

তিন দিন আগে চাঁদপুরের খাদিজার বাচ্চা হয়। এরপর থেকে শরীর খারাপ। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছবি: প্রথম আলো
তিন দিন আগে চাঁদপুরের খাদিজার বাচ্চা হয়। এরপর থেকে শরীর খারাপ। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছবি: প্রথম আলো

বাবুল মিয়াও ভর্তি হতে পারেননি

৬০ বছর বয়সী মো. বাবুল আগে প্লাস্টিকের ব্যবসা করতেন। কয়েক বছর আগে তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এখন হাঁটাচলা করতে পারেন না। এক সপ্তাহ ধরে তাঁর শরীর খুবই। বৃহস্পতিবার রাত থেকে কথাও বলতে পারছেন না। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে আসেন তাঁর মেয়ে সাথী আক্তার।

 
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে স্ট্রেচারে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন বাবুল মিয়া। সাথী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আব্বা অনেক দিন থেকে ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁর শরীর এখন খুবই খারাপ। কোনো কথা বলতে পারছেন না। তাই আব্বাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে এলাম। কিন্তু হাসপাতালে তো আমার আব্বাকে ভর্তি করাতে পারলাম না।’

কুমিল্লার খাদিজা আক্তার, ঢাকার ফরিদ মিয়া ও বাবুলের মতো আরও কয়েকজন রোগী ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যান। এসব রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যালাইড মেডিসিন ডিপার্টমেন্টকে করোনায় রূপান্তরিত করার পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা করোনা রোগী নন, যাঁদের ডায়বেটিকস আছে, হাইপার টেনশন আছে, এসব রোগীকে তো আমরা নিচ্ছি না। এটা তো অনেক আগের সরকারি নির্দেশনা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, এ ধরনের অনেক রোগীকে সোরওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের রোগীর চিকিৎসা হবে ওই সব হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেলে করোনা এবং সাসপেক্টেড করোনা রোগীদের ভর্তি করানো হবে। এর বাইরে রেসপিরেটরি মেডিসিন, কিছু ক্যানসারের রোগী, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি, হেপাটোলজির কিছু রোগী আমরা ভর্তি করাতে পারছি।’

পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ৭০০ করোনা রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর বাইরে এক হাজারেরও বেশি নন–কোভিড রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ক্যানসারে আক্রান্ত ফরিদ শুক্রবার সকালে যান জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। ভর্তি না নেওয়ায় আসেন ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেও ভর্তি নেওয়া হয়নি। ছবি: আসাদুজ্জামান
ক্যানসারে আক্রান্ত ফরিদ শুক্রবার সকালে যান জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। ভর্তি না নেওয়ায় আসেন ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেও ভর্তি নেওয়া হয়নি। ছবি: আসাদুজ্জামান

জনস্বাস্থ্যবিদ ও ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। মুমূর্ষ রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এটা চরম হয়রানি। এই হয়রানি বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, যদি কোনো হাসপাতাল রোগীকে ভর্তি না করে, তাহলে তারা সমাধান করবে। কোভিড হাসপাতাল হওয়ায় নন–কোভিড রোগীকে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি করাতে পারবে না, ভালো কথা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তো অন্য হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই সব রোগীকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশের সুফল যদি মানুষ না পায়, তাহলে সেই নির্দেশের কোনো মূল্য নেই। প্রতিটি হাসপাতালে একটা কাউন্টার থাকা উচিত। তাদের কাছে অন্যান্য হাসপাতালের তথ্য থাকবে। যে হাসপাতালে রোগী আসবে, সেই হাসপাতালে যদি সিট খালি না থাকে, তাহলে তারা অন্য হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং রোগীর ভর্তির ব্যবস্থা করবে।