করোনাকালে বেড়েছে বন্য প্রাণী হত্যা, বন বিনাশ

করোনার এই সময়ে মানুষের উৎপাত কমে যাওয়ায় দেশের অনেক স্থানে বন্য প্রাণীরা অবাধে বিচরণ করছে। আবার সেই সুযোগে বন্য প্রাণী হত্যাও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। গত বছর সুন্দরবনে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবাগি স্টেশন এলাকায়।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
করোনার এই সময়ে মানুষের উৎপাত কমে যাওয়ায় দেশের অনেক স্থানে বন্য প্রাণীরা অবাধে বিচরণ করছে। আবার সেই সুযোগে বন্য প্রাণী হত্যাও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। গত বছর সুন্দরবনে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবাগি স্টেশন এলাকায়। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

করোনাকালে মানুষ যখন গৃহবন্দী, তখন বিভিন্ন জনপদে হঠাৎ হঠাৎ বন্য প্রাণীর বিচরণ চোখে পড়েছে। যেটা চোখে পড়েনি, সেটা হচ্ছে গত চার মাসে বিশ্বে তো বটেই বাংলাদেশেও বন্য প্রাণী নিধন বেড়েছে। দুনিয়াজুড়ে আরও বেড়েছে বনের বিনাশ।  

এই সেদিন ভারতের কেরালায় অন্তঃসত্ত্বা একটি হাতি মানুষের নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে। বন বিভাগের হিসাবে বাংলাদেশে অন্য সময়ের চেয়ে গত চার মাসে বন্য প্রাণী হত্যা বেশি হয়েছে। আর বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) এক জরিপ বলছে, গত মার্চে দুনিয়াজুড়ে বন বিনাশ বেড়েছে দেড় গুণেরও বেশি।

করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–গুলোতে ফলাও করে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায় শহরে পেঙ্গুইনের হাঁটাহাঁটি, ভারতের সিকিমে জনবসতির চৌহদ্দিতে গন্ডারের আনাগোনা, অথবা ইতালির ভেনিসে বিলুপ্তিপ্রায় হাঁসের দল দেখা যাওয়ার মতো ঘটনাগুলোর খবর। পরিবেশপ্রেমীরা কার্বন নিঃসরণ কমে বাতাস নির্মল হওয়ায় উদ্বেলিত হয়েছেন।

অথচ এর উল্টো পিঠেই বেড়েছে বন ও বনের প্রাণী বিনাশের তৎপরতা। ডব্লিউডব্লিউএফ গত মে মাসের শুরুতে বন-অধ্যুষিত ১৭টি দেশের বনভূমির ওপরে লকডাউনের প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, গত মার্চে পৃথিবী থেকে সাড়ে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার বন উধাও হয়ে গেছে।

সংস্থাটির আরেকটি তড়িৎ জরিপ অনুযায়ী বন্য প্রাণী হত্যার প্রবণতাও অতীতের চেয়ে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এ রকম কোনো জরিপ হয়নি। তবে বন্য প্রাণী গবেষকেরা বলছেন, গত তিন মাসে দেশে অন্তত ২০টি ঘটনায় এক শর মতো বন্য প্রাণী হত্যার কথা গণমাধ্যমে এসেছে।

আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদারীপুরের শিবচরে বিষ দিয়ে ১২টি বানর হত্যা, চট্টগ্রামের হালদা নদী ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ৯টি ডলফিন হত্যা এবং সিলেটের জৈন্তাপুরে আটটি শিয়াল ও দুটি বনবিড়াল হত্যা।

আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের বাংলাদেশীয় পরিচালক রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কালে দেশে বন্য প্রাণীর প্রজনন ও বিচরণ বেড়েছে। একই সঙ্গে তাদের হত্যাও বেড়েছে। তাঁর মতে বনজীবী জনগোষ্ঠীর সাহায্যে বন ও বন্য প্রাণী রক্ষার উদ্যোগ জোরদার করা দরকার।

বন বিভাগের কর্মীরা গত মাসে ১২টি অভিযান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহাবিপন্ন লজ্জাবতী বানর, ধনেশ পাখি, বনবিড়াল এবং শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী উদ্ধার করেছে। বানর ও পাখি হত্যায় তারা চারটি মামলাও করেছে।

বন বিভাগের প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সংরক্ষক মিহির কুমার দো প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ সময়ে সংস্থাটি মাসে ছয় থেকে আটটি উদ্ধার অভিযান করে থাকে। তিনি বলছেন, বন্য প্রাণী পাচারের পথগুলো এখন বন্ধ। এসব প্রাণী বেচাকেনার অবৈধ বাজারগুলোও তাঁরা বন্ধ করতে পেরেছেন।

গত মে মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও (এফএও) চলতি বছরের বনভূমিবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারের প্রতিবেদনটিতে বনভূমি বাড়া-কমার কোনো তথ্য নেই। তবে বনভূমি বেশি ধ্বংস হওয়া দেশগুলোর তালিকায় ভারত ও চীনের মতো বাংলাদেশের নামও রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া সামগ্রিক অবস্থার একটি চুম্বক চিত্র হিসেবে প্রথম আলোকে বলেন হালদা নদীতে গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুইজাতীয় মাছের ডিম পাওয়া গেছে। আবার একই সঙ্গে এখানকার ডলফিন হত্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। তাঁর সুপারিশ, সরকারি সংস্থাগুলো যেন স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো ধরে রাখে এবং একই সঙ্গে প্রকৃতিবিধ্বংসী কাজগুলো বন্ধ করতে আরও কঠোর হয়।

এদিকে আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সংরক্ষণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবার মূলত অনলাইনে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর এই দিনটি আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করে। দিনটিতে মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা শুরু হয়। এবার সেগুলো বাতিল করা হয়েছে।


ইনসার্ট:
করোনাকালে পরিবেশ অনুকূল হয়েছে, কিন্তু মানুষের হাতে ধ্বংস ও বিনাশ বেড়েছে। আজ পরিবেশ দিবসের আহ্বান, প্রকৃতির সংরক্ষণ।