করোনাকালে হাসপাতালে একচিলতে সুখ হয়ে এসেছে এক 'পাগলির' নবজাতক
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ। সেখানে শনিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে ভবঘুরে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী (২৫) জন্ম দিয়েছেন একটি কন্যাসন্তান। ওই নারীর প্রকৃত নাম-পরিচয় কেউ জানে না, জানে না ওই শিশুর বাবার পরিচয়। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারীর সন্তান নিয়ে কোনো ভাবনা নেই, নেই কোনো আদর-যত্নের তাগিদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর প্রকৃত নাম-পরিচয় কেউ জানে না। বছর পাঁচেক ধরে আছেন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজারে বিভিন্ন ফুটপাত, বিপণিবিতানের মেঝে ও পার্ক করা গাড়িই ছিল তাঁর সংসার। দিনভর এদিক-সেদিক ছুটলেও ওই সব স্থানে রাত কাটাতেন ওই নারী। এলাকার মানুষ তাঁর নাম দিয়েছে চায়না আক্তার। সেই চায়না আক্তার শনিবার রাতে মা হলেও ওই নবজাতকের বাবা কে তা জানা যায়নি।
এ নিয়ে আজ সোমবার প্রথম আলোয় ‘পাগলিটা মা হলো, বাবা হলো না কেউ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে ফুটফুটে ওই শিশুটিকে ঘিরে হাসপাতালের নারী চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে শুরু হয়েছে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ। করোনাকালে পরিবার থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন ও হাসপাতালের বন্দিজীবনে একচিলতে সুখ হয়ে এসেছে শিশুটি।
আজ দুপুরে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, তিনজন নারী চিকিৎসক ওই শিশুর খোঁজ নিচ্ছেন। তাঁরা শিশুটিকে পরম মমতায় কোলে তুলে আদর করছেন। প্রসূতি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছিলেন সিনিয়র নার্স সাদিয়া আক্তার। এ সময় শিশুটিকে কোলে নিয়ে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাঁকে। তাঁর কোলে থাকা অবস্থায়ই এক নারী চিকিৎসক শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন। অন্য নারী চিকিৎসক ও নার্সরা বারবারই শিশুটির খোঁজ নিচ্ছিলেন। আর নার্স সাদিয়া তো শিশুটিকে চোখের আড়ালই করছিলেন না।
সাদিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাতে তো অনেক শিশুই জন্ম নেয়, চিকিৎসা নেয়। কিন্তু ওই পাগলির শিশুটিকে পেয়ে আমরা অন্য রকম সুখ অনুভব করছি। হয়তো করোনার কারণে দীর্ঘদিন পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে গিয়ে মনের অজান্তেই মাতৃত্ব বোধটা আরও বেশি জাগ্রত হয়েছে। গত দুই দিনে ওই শিশুকে ঘিরে আমরা একচিলতে সুখ খুঁজে পেয়েছি।’
ওই নারী ও শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন সদর হাসপাতালের চিকিৎসক সাবরিনা খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন নারী এভাবে সন্তান প্রসব করবেন, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। শিশুটিকে নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারীর মনের অবস্থা কী, তা আমরাও বুঝতেছি না। তিনি সার্বক্ষণিক শুয়ে থাকেন। কখনো নিজের মনেই ওয়ার্ডে, বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। তবে তাঁর সন্তানটি নিয়ে আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস রয়েছে। সুযোগ পেলেই দুই দিন ধরে সবাই তাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠছে।’
সাবরিনা খান বলেন, ‘আনন্দের মধ্যেও কিছুটা শঙ্কা আমাদের আছে। ওই নারী অসুস্থ, মানসিক ভারসাম্যহীন। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি কোথায় যাবেন, শিশুটির দেখাশোনা কে করবেন। তাকে ঠিকমতো ফিডিংও করানো যাচ্ছে না। এসব ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মানুষ কেন এমন হয়, কেন এ শিশুকে পৃথিবীতে এনে তার বাবা আড়ালে আছেন?’
নড়িয়া থানা সূত্র জানায়, শনিবার বিকেলে পুলিশের কাছে খবর আসে, নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী গাড়ির নিচে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। স্থানীয় লোকজন ওই নারীকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছিলেন না। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নড়িয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ গিয়ে দেখেন, ওই নারী প্রসববেদনায় ছটফট করছেন। দ্রুত তিনি তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদনে নিয়ে যান। সেখানে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রসব করাতে না পেরে রাত ১০টায় তাঁকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে পাঠান। শনিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান বলেন, ‘ওই নারী ও নবজাতক শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তাঁর শিশুসন্তান নিয়ে হাসপাতালের নারী কর্মী ও চিকিৎসকেরা খুব আনন্দ করছেন। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে হবে। তখন কী হবে, সেটা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি তাঁকে পুনর্বাসনের জন্য।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গাজীপুরে একটি আশ্রয় ও পুনর্বাসনকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ভবঘুরে, নিরাশ্রয় ও মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের আশ্রয় দেওয়া হয়। ওই আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁকে ও তাঁর শিশুসন্তানকে পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করা হবে। তিনি অনুমতি দিলে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। ওই শিশুটিকে এই মুহূর্তে কারও কাছে দেওয়া আইনগত বাধা রয়েছে। যেহেতু তাঁর মা বেঁচে আছেন। তবে ছয় বছর বয়স হলে তখন কোনো শিশু পরিবারে অথবা কেউ নিতে চাইলে দেওয়া যাবে। আগামী ছয় বছর ওই শিশুটিকে তার মায়ের সঙ্গেই থাকতে হবে।