ঈদকে ঘিরে ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ঈদ সামনে রেখে সীমিত আকারে দোকানপাট খোলা রাখার কথা থাকলেও নিয়ম মানছে না কেউ। খোলা হয়েছে সব দোকানপাট। অবাধে চলছে ব্যবসা–বাণিজ্য। মিরপুর ১, ঢাকা, ১৭ মে। ছবি: আশরাফুল আলম
ঈদ সামনে রেখে সীমিত আকারে দোকানপাট খোলা রাখার কথা থাকলেও নিয়ম মানছে না কেউ। খোলা হয়েছে সব দোকানপাট। অবাধে চলছে ব্যবসা–বাণিজ্য। মিরপুর ১, ঢাকা, ১৭ মে। ছবি: আশরাফুল আলম

সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী ঢাকায় গুচ্ছ লকডাউন অব্যাহত ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি সান্ধ্য আইন জারি করার কথাও ভাবতে বলেছেন আট বিশেষজ্ঞ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের এটাই পথ বলে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, ঈদের আগে ও পরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করার কথা ভাবা যেতে পারে।

এই আট বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। ১৫ মে অনুষ্ঠিত তাঁদের এক সভায় এসব প্রস্তাবের কথা বলা হয়। সভার কার্যবিবরণীতে এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে যুক্ত হতে হবে।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের তিনজন প্রথম আলোর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। স্থানীয় সাংসদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, এনজিও প্রতিনিধি, চিকিৎসক, মসজিদের ইমামসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। সঙ্গে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো এলাকায় লকডাউন সফল করতে এঁরা সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন।

বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করছি করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনগুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে সারা দেশে তা কমানো যাবে।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজধানীর টোলারবাগে ও বুয়েট এলাকায় সফলভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। ওই অভিজ্ঞতা ঢাকার অন্য এলাকায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

এই বিশেষজ্ঞ দলে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক দুই মহাপরিচালক এম এ ফয়েজ ও শাহ মুনির, জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল, আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ গবেষক আনোয়ার ইকবাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক মওদুদ হোসেন, উগান্ডায় ইবোলা মহামারির সময় ইউনিসেফের সাবেক উপদেষ্টা তারিক হোসেন, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন ও রিহ্যাবিলিটেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ফজলুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য লিয়াকত আলী।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় সব ধরনের কাজে অংশ নিতে সিটি করপোরেশন প্রস্তুত আছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো স্থান থেকে প্রস্তাব বা নির্দেশনা পেলে কাজে যুক্ত হব।’

>

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য আট বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ঈদের আগে ও পরে ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১৬ মের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট আক্রান্তদের ৫৭ শতাংশই ঢাকা শহরের মানুষ। মহামারির শুরু থেকেই ঢাকায় সংক্রমণের হার বেশি ছিল। পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া, লকডাউন শিথিল করা, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখার কারণে রাজধানীতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়টি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। কাঁচাবাজারে মানুষের ভিড়, রাস্তায় যানজটও দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কড়াকড়ি ব্যবস্থা না নিলে ঈদের সময় রাস্তায়-বাজারে জনসমাগম আরও বাড়বে। সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। সেই বিবেচনা থেকে তাঁরা বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থার কথা বলেছেন।

বিশেষজ্ঞদের এই প্রস্তাব তাঁরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে পাঠিয়েছেন। মহাপরিচালক অসুস্থ থাকায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সেবা বিভাগ) হাবিবুর রহমান খান গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, এসব সুপারিশ এখনো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের আগে জাতীয় কমিটিতে আলোচনা হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সান্ধ্য আইন জারি করা কঠিন কাজ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের দরকার হয়।

সান্ধ্য আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে এখনো কেউ পরামর্শ করেননি।

তবে আইইডিসিআরের পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কমিউনিটির মধ্যে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। নিম্ন আয়ের এলাকায় যুবকদের উপার্জনের কথাও ভাবতে হবে। ওই সব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় যুবকেরাও কাজে নামতে পারে। এভাবেই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।

চাই সবার সম্পৃক্ততা
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অধ্যাপক এম এ ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কমিউনিটির সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সফল উদাহরণ। স্বাস্থ্যের এই দুর্যোগের সময়ও কমিউনিটি বা জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল তৈরি করা, যন্ত্রপাতি সরবরাহ অব্যাহত রাখা—এগুলো কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য দরকার। কিন্তু সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য চাই জনগণের ও সরকারের আরও মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা।’

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একাধিকবার বলেছে, মহামারি মোকাবিলা করা একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এই কাজে সরকারের অন্য সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে যুক্ত হতে হবে। গোটা সরকার যুক্ত না হলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। তবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের বাইরে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা খুব একটা দৃষ্টিতে আসছে না।

সিটি করপোরেশন এলাকার মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো কর্মসূচি নেই। এসব এলাকায় আরবান প্রাইমারি হেলথ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অধ্যাপক শাহ মুনির বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা মেয়র-কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততা ছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় করোনা প্রতিরোধ সম্ভব হবে না।

টোলারবাগের উদাহরণ
করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম দিকের একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল রাজধানীর টোলারবাগ এলাকায়। ঘটনার পর রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) স্বাস্থ্যকর্মীরা এলাকায় ব্যাপকভাবে ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের’ কাজ করেছিলেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে এলাকায় লকডাউন করা হয়। একসময় রোগী বেড়ে ১৭ জনে দাঁড়ায়। আর মৃত্যুর ঘটনা ছিল দুটি।

টোলারবাগ এলাকার লকডাউন সফল করার জন্য স্থানীয় সাংসদ, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতিসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যুক্ত হয়েছিলেন। গতকাল টোলারবগে কোনো সংক্রমিত ব্যক্তি ছিল না।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘টোলারবাগে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করেছিলাম। আইইডিসিআরের স্বাস্থ্যকর্মীরা সশরীরে উপস্থিত থেকে কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ করেছেন। করোনা প্রতিরোধের ব্যাপারে স্থানীয় মানুষ, স্থানীয় সাংসদ সহযোগিতা করেছেন, সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সিটি করপোরেশন সক্রিয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে।’

এ ছাড়া ভৌগোলিকভাবে টোলারবাগের কিছু সুবিধা ছিল। সহজে অন্য এলাকা থেকে একে পৃথক করা সম্ভব বলে মনে করেন আইইডিসিআরের পরিচালক।

গুচ্ছ লকডাউন
মীরজাদী সেব্রিনা মনে করেন, টোলারবাগকে মডেল ধরে অন্য এলাকাতেও সাফল্য আনা সম্ভব। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় দরকার কমিউনিটির সম্পৃক্ততা, আর দরকার কাজের সমন্বয়।

ঢাকা শহর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রস্থল। শহরের জনসংখ্যা যেমন বেশি, পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষও বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ শহরের গুচ্ছ আকারে লকডাউন তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর হবে।

অধ্যাপক শাহ মুনির বলেন, ‘১০ জনের বেশি রোগী থাকলে সেই এলাকা আমরা লকডাউন করার কথা বলেছি। একটি বড় এলাকার মধ্যে লকডাউনের আওতায় থাকবে হয়তো একাধিক নির্দিষ্ট ছোট এলাকা। তাই একে আমরা গুচ্ছ বা ক্লাস্টার লকডাউন বলছি।’

আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১০ জন বা তার বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি আছে এমন এলাকা ঢাকা শহরে ১০৩টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক হলে ১০৩টি এলাকাতেই গুচ্ছ লকডাউন করা সম্ভব। গুচ্ছ লকডাউন এলাকায় কনট্যাক্ট ট্রেসিং ও রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা অব্যাহত রাখতে হবে। তাঁরা বলেছেন, এসব প্রস্তাব নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় বসা দরকার।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা দরকার। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কমিউনিটির সম্পৃক্ততা খুবই দরকার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কমিউনিটির সমস্ত অংশকে সচেতন করে তাকে সংক্রমণ প্রতিরোধে যেমন কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে, পাশাপাশি কমিউনিটিকে ত্রাণ বিতরণ, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া—এসব ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।