বাউলগানের আসর বন্ধ, বেকার পাঁচ শতাধিক শিল্পী
'প্রায় দুই মাস ধইরা বাউলগানের আসর বন্ধ। অথচ এই গান গাইয়াই আমার সংসার চলে। স্ত্রী-সন্তান নিয়া বড় বিপদে আছি। কাউরে কইতামও পারি না, সইতামও পারি না। একবেলা-আধাবেলা খাইয়া না-খাইয়া দিন যাইতাছে। এই বিপদ থাকি কবে যে উদ্ধার পাইমু!' কথাগুলো বললেন বাউল আবদুর রহমান (৬৫)।
প্রয়াত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য আবদুর রহমান বৃহত্তর সিলেটের একজন প্রবীণ বাউলশিল্পী। গীতিকার হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত। সদালাপী এই শিল্পীর সঙ্গে গতকাল শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে আলাপ করলে কণ্ঠে তাঁর আক্ষেপ ঝরে। বলেন, 'জান বাঁচাইতে ঘরে আছি, কিন্তু সংসার চলব কিলা? ভাইবা পাইতাছি না কুনতা। খালি আমার নায়, সব বাউলশিল্পীরই তো একই অবস্থা!'
বাউলশিল্পীদের একাধিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানের অনুষ্ঠানগুলোতে বাউলদের গান গাওয়ার ডাক পড়ছিল। ঠিক তখনই করোনাভাইরাসের হানা। সেই থেকে সারা দেশে বাউলগানের আসর বন্ধ হয়ে পড়ে। বাউলদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম পয়লা বৈশাখের আয়োজনও ছিল এবার বন্ধ। এ ছাড়া বোরো ধান উঠার পরপরই হাওরাঞ্চলে এই সময়টাতে প্রায় গৃহস্থ বাড়িতেই গানের আসর বসত। এবার সেটাও হবে না।
সিলেট নগরের নোয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাউলশিল্পী বশিরউদ্দিন সরকার (৫৬) বলেন, সিলেট বিভাগের চার জেলা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জে কমবেশি পাঁচ শ বাউল আছেন। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন শিল্পী বাদে বেশির ভাগই অস্বচ্ছল। গান গেয়েই তাঁরা আয়-উপার্জন করেন। এর বাইরে বিকল্প কোনো পেশা তাদের নেই। এ অবস্থায় গত দুই মাস ধরে গান গাইতে না পারার কারণে তাদের উপার্জন বন্ধ। বাউলদের কেউ কেউ ত্রাণ সহায়তা পেলেও অনেকেই এ সুবিধার বাইরে আছেন।
কয়েকজন বাউলশিল্পী বললেন, উপার্জন বন্ধ হয়ে পড়ায় তাঁরা চরম কষ্টে অমানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘরে খাবারের অভাবে উনুন জ্বলছে না। লাজ-লজ্জায় কাউকে নিজের অসহায় অবস্থার কথা বলতেও পারছেন না। স্ত্রী-সন্তান-পরিজন নিয়ে অনেক বাউল এখন তাই দুঃখ-কষ্টে সময় কাটাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বুড়াইরগাঁও গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মো. চন্দন মিয়া (৬৮)। প্রবীণ এই বাউলশিল্পীর স্ত্রী রেহানা বেগমও (৪৯) একজন শিল্পী। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরাও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন। চন্দন মিয়া বলেন, 'কী যে এক অবস্থা আইল! ঘরে বইসা আছি। গানের আসর বন্ধ। বড় বেকায়দায় পড়ি গেলাম।'
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার গানপুর গ্রামের বাসিন্দা বাউল আজগর আলী (৫৯) বলেন, 'গান ছাড়া আমার আর পেশা নাই। দুই মাস ধারি বাড়িত বন্দী আছি। চোখে এখন আন্ধাইর দেখতাছি।' স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ চার সদস্যের পরিবার তাঁর। কিন্তু একমাত্র আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি অসহায়বোধ করছেন।
বাউল কল্যাণ সমিতি সিলেট বিভাগের সভাপতি কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, 'বাউলগান আমাদের ঐতিহ্য। এ গানের আসর করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকায় সিলেট বিভাগের বাউলশিল্পীরা এখন আয়হীন হয়ে পড়েছেন। এতে তাঁরা অমানবেতর ও দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ সরকারিভাবে এসব শিল্পীদের এখন পর্যন্ত কোনো অনুদানই দেওয়া হয়নি। আমরা বাউলশিল্পীদের বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।' সিলেট বিভাগে পাঁচ শতাধিক বাউলশিল্পী আছে বলে তিনি জানান।