দেশে স্বাভাবিক জীবনের শুরু বিলম্বিত হতে পারে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই। দেশে সংক্রমণ কত দিন প্রবলভাবে বজায় থাকবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যাচ্ছে। সময় গড়ালেও করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বলই থেকে যাচ্ছে। হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রা কবে স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এদিকে দেরিতে হলেও দেশব্যাপী রোগ সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে নজরদারি সমীক্ষা শুরু করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। যৌথ এ সমীক্ষায় তাদের সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এই সমীক্ষা থেকে জানা যেতে পারে, দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা প্রতিরোধক্ষমতা আদৌ গড়ে উঠছে কি না এবং গড়ে উঠলে তা কী মাত্রায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ কখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে (পিক) উঠবে বা সংক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে কত দিন বজায় থাকবে, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। লকডাউন (অবরুদ্ধ) শিথিল করা, পোশাক কারখানা চালু করা এবং দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই মতভেদ তৈরি হয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘এখন জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে আগের পূর্বাভাস অনুযায়ী জুলাই থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার শুরু বিলম্বিত হতে পারে।’

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বিশ্বের মতো আমরাও শিখছি। অনেক সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, সরকারের সমালোচনা করা

সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু ব্যক্তির সুরক্ষা নিজের কাছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষার বার্তা দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তারপরও মানুষ কেন ঝুঁকি নিয়ে দোকানে ভিড় করছে?’

মৌলিক সমস্যা

করোনা প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় সংক্রমিত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণার আগে থেকেই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে এসেছে। পরীক্ষা করে শনাক্ত ব্যক্তিকে আলাদা করতে হবে, তাকে চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে। সংক্রমিত ব্যক্তির সান্নিধ্যে বা সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে শনাক্ত করে (কনট্যাক্ট ট্রেসিং) তাদের নজরদারিতে আনতে হবে। প্রথমে কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ), কোয়ারেন্টিন থেকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ), সেখান থেকে প্রয়োজনে হাসপাতালে নিতে হবে তাদের। সারা বিশ্ব এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে করোনা মোকাবিলা করছে।

করোনা মোকাবিলার মৌলিক এই জায়গায় বাংলাদেশ শুরু থেকেই দুর্বল থেকে গেছে। দেশে এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৬৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর অর্ধেক ঢাকা শহরের। তবে এসব ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা এসেছেন, তা খুঁজে দেখার কাজে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

শুরু থেকে আইইডিসিআরের নিয়ন্ত্রণে ছিল নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা, ফল জানানোর কাজ। শুরুতে সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষায় যুক্ত করা হয়নি। এখন ৩৮টা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চলছে।

>

জনস্বাস্থ্যবিদদের পূর্বাভাস ছিল, জুলাইয়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু হতে পারে
কিন্তু বিধিনিষেধ শিথিল, স্বাস্থ্যবিধি না মানায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
স্বাভাবিক জীবনের শুরু বিলম্বিত হতে পারে

গতকাল মহাখালীর এক যুবক প্রথম আলোতে ফোন করে কেঁদে ফেলেছেন। জানতে চেয়েছেন, কোথায় গেলে তিনি নমুনা পরীক্ষা করাতে পারবেন। ওই যুবক এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছেন, সঙ্গে গলায় ব্যথা। আইইডিসিআরের দেওয়া নম্বরে ফোন করে নমুনা দেওয়ার ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছেন। রোদে পুড়ে জ্বর শরীরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গেছেন। এরপর প্রথম আলোতে ফোন করেছেন। এ রকম অভিযোগ অনেকের কাছ থেকেই আসছে।

আইইডিসিআর এখন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে না। ঢাকা শহরে নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ১৯টি বুথে এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারের ৫টি কেন্দ্রের ৩০টি বুথে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক মোরশেদা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একটি বুথে দৈনিক ৩০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ রকম আরও ২০টির মতো বুথ ঢাকা শহরে করার পরিকল্পনা তাঁদের আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার সুপারিশ করেছিল। সর্বশেষ এক দিনে ৬ হাজার ৭৭৩ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।

দুই দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেছিলেন, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত আছে।

হাসপাতাল নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, করোনার জন্য নির্ধারিত ঢাকা শহরের ১১টি হাসপাতালে এবং ঢাকাসহ আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে গত সোমবার ৩ হাজার ১৭২ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। ১১ হাজারের মতো রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

অভিযোগ আছে, করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে শয্যা সীমিত হওয়ায় অনেকে ভর্তি হতে পারছেন না। অন্যদিকে করোনায় আক্রান্ত নন এমন রোগীও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই দুটি সমস্যা সমাধান করতে পারছে না।

সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, করোনার রোগী নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা নেবে। কিন্তু বাকি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত নয় এমন অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘করোনা পরীক্ষায় ঋণাত্মক’ এমন সনদ দেখতে চায়। চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে একাধিক রোগীর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। গত শনিবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের মৃত্যুতে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়েছিল, সরকারি–বেসরকারি কোনো হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরত দেওয়া যাবে না। হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সমন্বিত সেবার ব্যবস্থা না করলে রোগী ভর্তির সমস্যা দূর হবে না। একই হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত ও করোনায় আক্রান্ত নয়—এমন সব রোগীর চিকিৎসা হবে। এতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স—সবাইকে কাজে লাগানো যাবে। এখানে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই শিখছি। আমরা জানতে পেরেছি যে বিশ্বের অনেক দেশে একই হাসপাতালে সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। আমরাও সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করব। করোনা রোগী যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমাদের হাসপাতালে বেশি শয্যার দরকার হবে।’

ঝুঁকি বাড়ছে

আটজন জনস্বাস্থ্যবিদ নানা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাঁরা গত মাসে বলেছিলেন, মে মাসের শেষ নাগাদ দেশে ৪৮ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে ১ হাজার। সংক্রমণ পরিস্থিতি প্রায় স্তিমিত হয়ে আসতে পারে জুনের শেষ সপ্তাহে। জীবন প্রায় স্বাভাবিক হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে।

গতকাল আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা নিয়ে দেশে–বিদেশে নানা ধরনের প্রক্ষেপণ হয়েছে। সবচেয়ে দুর্বল ছিল সিঙ্গাপুরের প্রক্ষেপণ। কারণ, তাতে বাংলাদেশের ভুল তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রক্ষেপণ মোটামুটি ঠিক আছে বলে তিনি মনে করেন।

তবে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া, দোকানপাট চালু করা এবং লকডাউন শিথিল করায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা খোলা রাখলে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হবে না। তিনি মনে করেন, অন্য দুটি বিষয় নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। এখন বিদেশ থেকে যাঁরা আসছেন, ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন না হলে তাঁরা সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। দ্বিতীয়ত, দোকানপাটে তেমন কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।

ইউরোপের একটি দেশের দাতা সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান এবং দেশের একজন শীর্ষ রোগতত্ত্ববিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, পোশাক কারখানা, দোকানপাট এবং প্রবাসীদের আসা নতুন ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনটি ক্ষেত্রেই কঠোর নজরদারি না হলে পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

এদিকে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও নিবিড়ভাবে জানার জন্য দেশব্যাপী নজরদারি সমীক্ষা শুরু করেছে। জানা গেছে, এ মাসের শুরুতে জয়পুরহাট থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে। রোগের লক্ষণ আছে এবং রোগের লক্ষণ নেই—এমন মানুষের রক্তের নমুনাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেখা হবে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠছে কি না, গড়ে উঠলে কোন মাত্রায়। এ ছাড়া সংক্রমণের ব্যাপ্তিও দেখা হচ্ছে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কোনো কিট এখনো অনুমোদন দেয়নি। অনুমোদন দিলে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হবে। তিনি বলেন, কাজটি শেষ হতে এক মাসের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।