খাদ্যসংকটে উপকূলের ৫৭ শতাংশ পরিবার: জরিপ
কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে ঘরবন্দী থাকায় উপকূলের ৫৭ শতাংশ পরিবার খাদ্যসংকটে পড়েছে। অতিরিক্ত সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৬৩ শতাংশ পরিবার। বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতাও। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল না থাকার কারণে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা কোস্টট্রাস্টের করা এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার সংস্থাটির পক্ষ থেকে ওই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংস্থাটির মনিটরিং ও গবেষণা বিভাগ এ জরিপ পরিচালনা করে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বাংলাদেশে ঘোষিত লকডাউনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে—এ নিয়ে উপকূলীয় ছয়টি জেলায় জরিপ পরিচালনা করে কোস্টট্রাস্ট। জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা। গত ২৫ এপ্রিল এ জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। শেষ হয়েছে ৭ মে।
কোস্টট্রাস্টের মনিটরিং ও গবেষণা বিভাগ জানায়, ছয়টি জেলায় সংস্থাটির ১২টি শাখার অধীনে ২৪০ জন দরিদ্র নারীপ্রধান ও নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়। এটির ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা গ্রামে এবং ১৭ শতাংশ শহরে বাস করেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার।
জরিপে দেখা যায়, লকডাউনের ফলে ৪২ শতাংশ পরিবার তিনবেলা খেতে পারছে। দিনে দুই বেলা খেতে পারছে ৫২ শতাংশ পরিবার এবং ৫ শতাংশ পরিবার দিনে এক বেলা করে খাচ্ছে। সপ্তাহে ৩-৪ দিন মাছ, মাংস বা ডিম অর্থাৎ নিয়মিত প্রোটিন খেতে পারত ৫৬ শতাংশ পরিবার। ঘরবন্দী থাকার ফলে তা নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। ৮৭ শতাংশ পরিবার এখন সপ্তাহে ১-২ দিন প্রোটিন গ্রহণ করছে। এতে আরও দেখা যায়, লকডাউনের কারণে পরিবারের পুরো আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৪ শতাংশ পরিবারের। আয় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে ৩৯ শতাংশ পরিবারের এবং অর্ধেকে নেমে এসেছে ১৯ শতাংশ পরিবারের। তবে নারীপ্রধান পরিবারের ক্ষেত্রে এই চিত্র ভিন্ন। এ ধরনের পরিবারে আয় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৬ শতাংশ পরিবারের। ৩০ শতাংশ পরিবারের আয় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।
৬৩ শতাংশ পরিবার চলমান সংকট মোকাবিলায় চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করেছে ১৮ শতাংশ পরিবার এবং কোথাও ঋণ পায়নি বলে জানিয়েছে ১৩ শতাংশ পরিবার। সংকট মোকাবিলায় সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে ৪৮ শতাংশ পরিবার। গরু-ছাগল বিক্রি করে ফেলেছে ৩৫ শতাংশ পরিবার। নারীপ্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সঞ্চয় ভাঙা, গরু-ছাগল বা গয়না বিক্রি করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় ছিল না। জরিপের ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, লকডাউনে পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গালাগালি বা কটূক্তির ঘটনা ঘটেছে ৮২ শতাংশ পরিবারে। ৯ শতাংশ পরিবারে গায়ে হাত তোলা এবং ৯ শতাংশ পরিবারে যৌতুকের জন্য চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
লকডাউন চলমান থাকলে কী পরিকল্পনা রয়েছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে ৭৮ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের হয়তো এনজিও বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। না পাওয়া গেলে চড়া সুদে মহাজনের থেকে ঋণ করতে হবে। এ ছাড়া বাদবাকি সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হবে বলে জানিয়েছে ৩৮ শতাংশ পরিবার। গরু-ছাগল বা গয়না বিক্রি করে ফেলবে ২০ শতাংশ পরিবার। দাদনে আগাম শ্রম বিক্রি করবে ১৫ শতাংশ, নারীপ্রধান পরিবারে এই হার ১৮ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ পরিবার এনজিওর কাছ থেকে নানা ধরনের ঋণ সহায়তা চেয়েছে, যা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা নতুন ঋণ চেয়েছেন, ১৩ শতাংশ চলমান ঋণ বৃদ্ধির দাবি করেছেন এবং ৪৩ শতাংশ সহযোগিতামূলক ঋণ বা আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন। ঋণপ্রত্যাশীদের প্রায় সবাই তাঁদের জীবিকার জন্য বিনিয়োগ করবেন। ৬৯ শতাংশ পরিবার এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাছ থেকে ত্রাণসহায়তা দাবি করেছে এবং ২১ শতাংশ পরিবার নগদ অর্থসহায়তা চেয়েছে।
জানতে চাইলে কোস্টট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পারায় একজন দরিদ্র মানুষকে হত্যা করা হয়। নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট বুঝতে পেরেই কোস্টট্রাস্ট এই জরিপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তিনি আরও বলেন, খাদ্যসংকটে পড়া মানুষের সহায়তায় কোস্টট্রাস্ট নিজেদের আয় থেকে উপকূলীয় ৯টি জেলার ৪৯টি জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিলে ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে।