পরিবারটি চলবে কীভাবে?
একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জাকির হোসেন পাঠান মারা গেছেন পাঁচ দিন আগে। তিনি করোনা পজিটিভ (কোভিড–১৯) ছিলেন। পরিবারটির সব থেকে ছোট দুই বছর বয়সী সদস্যটি ছাড়া অন্যরা সবাই করোনা পজিটিভ। চিকিৎসা নিচ্ছে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
করোনায় মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি সামনের দিনগুলো কীভাবে পাড়ি দেবেন, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন জাকির হোসেনের স্ত্রী ও সন্তানেরা। জাকির হোসেন পরিবার নিয়ে থাকতেন কেরানীগঞ্জে। পুরান ঢাকায় একটি চাল–ডালসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির দোকানে কাজ করে জাকির হোসেন সামান্য বেতন পেতেন। সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। চাঁদপুরে সামান্য পৈতৃক সম্পত্তি থাকলেও কোনো বাড়ি করেননি। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলের কাছে করোনার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, সে চিন্তায়।
কুর্মিটোলায় দায়িত্ব পালনকারী এক চিকিৎসকের সহায়তায় জাকির হোসেনের মেয়ে ফাহমিদা পাঠানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। কলেজপড়ুয়া এই মেয়েটিই জাকির হোসেনের সন্তানদের মধ্যে সবার বড়। ফাহমিদাও কুর্মিটোলা হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে ঘুরে এসেছে। শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতায় কয়েক ঘণ্টা সে ছিল আইসিইউতে।
সোমবার টেলিফোনে কথা হয় ফাহমিদা পাঠান ও তার মা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে। শাহনাজ বেগম জানান, তিনি নিজে এবং ১৭ বছর বয়সী মেয়ে ফাহমিদা, ১৪ বছর বয়সী ছেলে মুজাহিদ, ১২ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাতুল সবার করোনা পজিটিভ। শুধু দুই বছর বয়সী ছেলে জুনায়েদের করোনা নেগেটিভ এসেছে। কয়েক দিন ধরেই শাহনাজ বেগম জুনায়েদকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। জুনায়েদের করোনা না হলেও যত্নের অভাবে শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো না। মা ছাড়া অন্যদের হাতে খাবারও খাচ্ছিল না। জুনায়েদের নানা–নানি এসে তাকে গতকাল রাতে চাঁদপুরে নিয়ে গেছেন।
শাহনাজ বেগমের শারীরিক অবস্থাও ততটা ভালো নয়। জানালেন, মাঝেমধ্যেই শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। একদিকে সংসার চালানোর চিন্তা, অন্যদিকে হাসপাতালেই ভর্তি কোনো সন্তানের অবস্থা কখন খারাপ হয়ে যায়, সে চিন্তা তো আছেই। মেয়েটা চোখের সামনেই আইসিইউ থেকে ফেরত এসেছে। বললেন, ‘আমি তো চোখে অন্ধকার দেখতাছি। সামনের দিনগুলান কেমন করে পাড়ি দিব, একমাত্র আল্লাহই জানেন। কপাল ভালো যে এই হাসপাতালে ভালা চিকিৎসা পাইতাছি, কোনো খরচও লাগতেছে না। আমার কেউ নাই বইল্যাই বোধ হয় ডাক্তারের বেশে আল্লাহ ফেরেশতা পাঠাইছে আমার পরিবারের কাছে।’
জাকির হোসেন বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে মেয়ে ফাহমিদা পাঠান একা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করেছে। তার অভিযোগ, তার বাবা তেমন একটা চিকিৎসা না পেয়েই মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান জাকির হোসেন।
ফাহমিদা বলল, ‘আমার বাবা যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে আমাদের খাওয়া আর পড়াশোনাটা কোনোমতে চালিয়ে নেওয়া যেত। এখন বাবা নেই। মা অসুস্থ। আমিসহ অন্য ভাইবোনেরাও অসুস্থ। জানি না সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। আমাদের যে চলবে কেমনে, তাও জানি না। হাসপাতালের ডাক্তাররা আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কেরানীগঞ্জে ছোট একটা ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেখানে যে কত দিন থাকতে পারব, তাও জানি না।’
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমদ টেলিফোনে বললেন, ‘পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভালো না। পরিবারের প্রায় সব সদস্যই করোনা পজিটিভ। এখানে শুধু এ পরিবার না, সব করোনা রোগীকে একদম বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও খাবার দেওয়া হচ্ছে। পরিবারটি যত দিন হাসপাতালে আছে, তত দিন চিকিৎসাসহ অন্য কিছু নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা পরিবারটির পাশে আছি। কিন্তু সমস্যা হলো, পরিবারটি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর চলবে কীভাবে? সামনে তো দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে পরিবারটিকে।’
জাকির হোসেন পাঠান যে দোকানে কাজ করতেন, ওই দোকানের মালিক হাজি মুসলিম নিজেও কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নিজেও বলতে গেলে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত এসেছেন। টেলিফোনে জানান, তিনি যেহেতু নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পেরেছেন, তিনি জাকির হোসেনের পরিবারের পাশে থাকবেন তাঁর সাধ্য অনুযায়ী।