কার্টুনিস্ট-লেখক-সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার চায় এইচআরডব্লিউ
করোনাভাইরাস নিয়ে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়েছে।
জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে প্রবাসী সাংবাদিক, কার্টুনিস্টসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ৬ মে রমনা থানায় মামলা করেছে র্যাব-৩ । অভিযুক্ত ১১ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ৩১ ও ৩৫ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে যাতে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এই মামলায় আসামি করা হয়েছে, কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোর, ব্যবসায়ী মোস্তাক আহম্মেদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য মো দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, মিনহাজ মান্নান, প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও সাহেদ আলম, সায়ের জুলকারনাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ ও ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। এর মধ্য চারজনকে গেপ্তারের পরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া যে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে এমন কোনো কিছু বন্ধ করতে হবে। ১১ জনের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে ও কারাগারে থাকা চারজনকে মুক্তি দিতে হবে। এ ছাড়া কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, 'কেবল একটি অনিরাপদ ও স্বৈরাচারী সরকার কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক এবং নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য মহামারিকে ব্যবহার করে। কেবল ব্যাঙ্গো-বিদ্রূপ পোস্ট করার কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে এমন মামলা দায়ের না করে বরং আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং কোভিড -১৯-এর বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়াতে যেকোনো ফাঁক থাকলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা উচিত।'
করোনভাইরাস পরিস্থিতি পরিচালনার বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের চলমান ব্যবস্থার মধ্যে এই মামলা করা হয়েছিল। গতকাল ৭ মে সরকার পরিপত্র জারি করে সরকারি চাকরিজীবীদের সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই আদেশ লঙ্ঘন করলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এইচআরডাব্লিউর বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ গুজব ছড়িয়ে দিতে পারে এমন যেকোনো ব্যক্তির ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে এবং মিডিয়া সেন্সরশিপে জোর দিয়েছে।কোভিড-১৯ গুজব শনাক্ত করার জন্য র্যাব অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) সাইবার ভেরিফিকেশন সেল তৈরি করেছে।
র্যাবের কর্মকর্তারা কিশোরের বাসায় অভিযান চালিয়ে তার ফোন এবং কম্পিউটার জব্দ করে। সরকারি দলের নেতাদের কার্টুন এঁকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও গুজব ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়ার অভিযোগ কিশোরের বিরুদ্ধে আনা হয়। লাইফ ইন দ্য টাইম অব করোনা শীর্ষক কিছু কার্টুন ফেসবুকে পোস্টে করেন কিশোর যাতে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা ও সরকারের কোভিড -১৯ প্রতিক্রিয়াতে দুর্নীতির অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য মো. দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া সরকারের করোনা ভাইরাসে নেওয়া সরকারের নীতির একজন সমালোচক। তিনি সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্নীতি ও ব্যর্থতা পর্যবেক্ষণে গঠিত একটি কমিটির সদস্য। গত ৩০ এপ্রিল এই কমিটি ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দে অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলে।
অনলাইন নিউজ সাইট নেত্র নিউজের সম্পাদক খলিল। একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিবেদন প্রকাশের পর নেত্র নিউজ পোর্টালটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের ভেতর ব্লক বা বন্ধ করা হয়েছে। নেত্র নিউজ সম্প্রতি একটি ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে অনুমান করা হয়, করোনাভাইরাসকে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশে বহু মানুষ মারা যেতে পারে। তাসনিম খলিলের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর অভিযোগ তিনি জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ, করোনভাইরাস মহামারি সম্পর্কে ফেসবুকে ভুয়া সংবাদ এবং অবমাননাকর মন্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
ডিজিটাল নিারপত্তা আইনটি জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সাংবাদিক এবং আরও অনেকে সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশ নাগরিক সমাজের ৩১১ জন সদস্য একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে সরকারকে বাক স্বাধীনতা বহাল রাখতে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাটি জানায়, সরকারের সমালোচনা করায় দেশে বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকার সকল সরকারী হাসপাতালের নার্সদের পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকার এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম নিয়ে কথা না বলার জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে। দেশ একশোর বেশি চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থাটি মনে করে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে সরকারে সব ধরণের তথ্য অনুসন্ধান, প্রাপ্তি এবং প্রদানের অধিকারসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে সরকার, জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করার স্বাধীনতা অর্ন্তভুক্ত।
ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, 'কোভিড -১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাকস্বাধীনতা যে মূল বিষয় সেটি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া অতি জরুরি। সরকারের সাংবাদিক, ডাক্তার এবং নার্স ও অ্যাক্টিভিস্টদের হয়রানি করা বন্ধ করা উচিত এবং এর পরিবর্তে সহায়তা, স্বচ্ছতা এবং সম্পদ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করা যায়গাগুলোতে কাজ করা উচিত।'