কারখানার শতভাগ কর্মীকে মাস্ক পরতেই হবে
কারখানার শতভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে পরার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কারখানাগুলোর ভেতরে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব। তাই শ্রমিকদের অ্যাপ্রোন পরতে হবে। মাথা ও জুতা সার্বক্ষণিক ঢেকে রাখতে হবে। জনগণের ঘরে ঘরে সেবা কার্যক্রম পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়ে চালু করার সুবিধার্থে কারিগরি নির্দেশনামূলক পুস্তক তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও পেশার জন্য কারিগরি নির্দেশনা রয়েছে। গত শনিবার প্রস্তুত করা পুস্তকটি গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৮ মার্চ দেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে আটজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেয়। এই বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার সম্ভাব্য উপায় ও সতর্কতামূলক কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে একটি নির্দেশনামূলক পুস্তক তৈরি করেছেন। বিশেষজ্ঞরা চীন ও অন্যান্য দেশের কারিগরি নির্দেশনা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের জন্য এই কারিগরি নির্দেশনামূলক পুস্তক প্রণয়ন করেছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তৈরি করলেও পুস্তিকাটির শুরুতেই বলা হয়েছে, এই নির্দেশনায় যা–ই থাকুক না কেন, সরকার সময়ে সময়ে যেসব কঠোর, মধ্যম ও স্বল্পমাত্রার পদক্ষেপ নেবে, সেগুলো অবশ্যই যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।
কারিগরি নির্দেশনামূলক পুস্তকটিতে বাড়ি, অফিস, হোটেল, ব্যাংক, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, শপিং মলে যাতায়াতকারীদের জন্য করণীয় বিষয়ে পৃথক নির্দেশনা রয়েছে। সড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয়গুলো বলা হয়েছে। গার্মেন্টস, হোসিয়ারি, চামড়া ও টেক্সটাইল কারখানা, নির্মাণশিল্প, শিশু যত্ন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বৃদ্ধ নিবাস চালু ও সেখানে অবস্থানকারীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
পুস্তকে প্রবীণ নাগরিক, গর্ভবতী মা, শিশু, শিক্ষার্থী, পুলিশ সদস্য, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কী কী স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সেটির উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে দেওয়া নির্দেশনা কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জন্য। কিছু বিষয়ের জন্য মধ্য ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে করণীয় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারখানার ভেতর ও বাইরে
গত ২৬ এপ্রিল থেকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ধাপে ধাপে চালু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বলছে, কারখানাগুলোর ভেতরে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব। তারপরও কারখানার বাইরে, প্রবেশের সময় এবং ভেতরে প্রতিপালনের জন্য কিছু স্বাস্থ্যবিধি নির্ধারণ করেছে কমিটি। কারখানার শতভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হবে।
>অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর উপায় ও সতর্কতামূলক কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
কারখানার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আলাদা থাকতে হবে। কারখানার ভেতরে পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার জায়গা থাকতে হবে। কারখানার কোনো কর্মকর্তা, শ্রমিকের করোনার উপসর্গ থাকলে কারখানায় প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। তাঁদের কিছু ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিতে হবে এবং তিন দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এ রকম কাউকে পাওয়া গেলে কোভিড-১৯ পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠাতে হবে এবং কারখানার আশপাশেই কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে।
বাড়ি ও ভবন
বাড়িতে বিজ্ঞানভিত্তিক, সঠিক পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত জোরদার করতে বলেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে বলা হয়েছে। একই তোয়ালে একাধিকজন ব্যবহার না করা, সকালে ও সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে বলা হয়েছে। বায়ু চলাচলের জন্য জানালা ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য দিনে দুই থেকে তিনবার খুলে দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অফিস, হোটেল, শপিং মল, ব্যাংক
খোলার আগে মহামারি–প্রতিরোধী সামগ্রী (মাস্ক, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী) সংগ্রহ করতে হবে। আপৎকালীন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আপৎকালীন সংক্রমিত বস্তুর ডিসপোজাল এলাকা স্থাপন করতে হবে। ঘনঘন সংস্পর্শে আসা জায়গা (যেমন দরজার হাতল, লিফট ও শৌচাগারের সারফেস) নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
কর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পোস্টার, ইলেকট্রনিক স্ক্রিন ও বুলেটিন বোর্ডের মাধ্যমে স্বাস্থ্যজ্ঞান পরিবেশন জোরদার করতে হবে। কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। হাত পরিষ্কারের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বায়ু চলাচল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
রেল, সড়ক ও নৌপথে যাত্রী পরিবহন
স্টেশন ও টার্মিনালগুলোতে জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশকের পর্যাপ্ত মজুত থাকতে হবে। আগত ও নিগত যাত্রীদের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। যাত্রীদের অনলাইনে টিকিট ক্রয় করার পরামর্শ দিতে হবে। পরিবহনের ধারণক্ষমতা সীমিত করতে হবে এবং সীমিত আকারে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে যাত্রীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একটি জরুরি এলাকা স্থাপন করতে হবে, যেখানে সন্দেহজনক উপসর্গ রয়েছে এমন যাত্রীদের অস্থায়ী কোয়ারেন্টিনে রাখা যায়।
ওয়ার্ড, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা
সামগ্রিক মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা থাকতে হবে। নির্দিষ্ট লোকালয়ে বসবাসকারীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা তদারকি ও অনুসন্ধান করতে সে প্রশাসনিক অঞ্চলের কর্মচারীদের সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে হবে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ব্যক্তিদের যথাসময়ে স্ক্রিনিং করতে হবে।
বৃদ্ধ, শিশু, বিশেষ রোগে আক্রান্তদের অন্যের সংস্পর্শে আসা কমাতে হবে। ২৪ ঘণ্টা হটলাইন ও অনলাইন সেবা দেওয়ার জন্য মেডিকেল প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ঘরে ঘরে সেবা কাযক্রম পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কমিউনিটিতে সুনিশ্চিত কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তত্ত্ববধানে উচ্চমাত্রার জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া চালাতে হবে।
বৃদ্ধ নিবাস
বয়স্কদের প্রতিদিনের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছে কমিটি। বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত রেকর্ড পূর্ণাঙ্গরূপে রাখতে হবে। বয়স্ক নিবাসে যারা থাকেন তাঁদের মূল রোগ ও লক্ষণ পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে। হাসপাতাল, হাসপাতালে সেবার সময়, যানবাহন, সঙ্গে যাওয়ার মতো কর্মী, পরীক্ষা দ্রব্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী
পরিচ্ছন্নতাকাজে উপযুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার এবং নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। সুস্থ কর্মী ছাড়া অন্য কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন না। পরিচ্ছন্নতাকাজের পর কর্মীর কাপড় ও সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিচ্ছন্নতার সময় কোনো মাস্ক পাওয়া গেলে সেটি হাত দিয়ে না ধরার নির্দেশ দিয়েছে কমিটি।