হাম নিয়ে অশনিসংকেত, ব্যাপক ছড়াতে পারে
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, টানা অগ্রগতির পর বছর তিনেক ধরে হাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছিল। এর মধ্যেই বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে ব্যাপকভাবে শিশুরা হামে আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই ইউনিসেফ বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শিশুরা যদি তাদের জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন না পায়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়াকে স্বাস্থ্যখাতে আরেকটি জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশের শিশুরা ৯ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে হামের প্রথম ডোজ টিকা এমআর-১ এবং ১৮ মাস বয়সে দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল মেয়াদে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়।
এই কর্মসূচির দশ বছর বয়স পর্যন্ত ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে হামের টিকা দেওয়ার কথা ছিল।
হাম ভাইরাসজনিত রোগ। চিকিৎসকেরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত শিশুর প্রচণ্ড জ্বর থাকে এবং এই জ্বর চার থেকে সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শিশুর নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়ে, চোখ লাল হয়ে যায়। গালে সাদা ছোপছাপ দেখা যায়। এরপর মুখমন্ডল ও গলার ওপর থেকে র্যাশ বের হয় এবং হাতে পায়ে ছড়ায়। সবচেয়ে সংক্রামক ব্যাধির একটি হাম। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায় এবং দুই ঘন্টা পর্যন্ত ভাইরাস টিকে থাকে। শরীরে র্যাশ বের হওয়ার চারদিন আগে থেকে পরবর্তী চারদিন পর্যন্ত রোগটি বেশি ছড়ায়।
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, হাম পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মারাত্মক ছোঁয়াচে এই রোগের কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একরকম নষ্ট হয়ে যায়, শিশু মস্তিষ্কে সংক্রমণ (এনকেফেলাইটিস), নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও যক্ষ্মায় ভুগে মারা যেতে পারে।
হাম নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ হাম নিয়ন্ত্রণে জোরেসোরে কাজ শুরু করে। প্রতি সপ্তাহে ১৬৭টি জায়গা থেকে নিয়মিত এবং অনিয়মিত হলেও আরও ৭৯২টি জায়গা থেকে ইপিআই নিয়মিত তথ্য পেয়ে থাকে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে বড় পরিসরে হাম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় হামের সংখ্যা কমেছিল। ২০১৭ সাল থেকে আবারও এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে ২১৩৬ জন শিশু হামে সংক্রমিত হয়। পরের বছর, অর্থাৎ, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৮৭৫ জনে। চলতি বছরের ১৭ সপ্তাহ বা চার মাস এক সপ্তাহে ১৫০০ শিশু হামে সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
দেশের ভেতর ৪৫ টি জায়গায় এ বছর হামের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছটি প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে ইপিআই। ওই ছটি এলাকার নমুনা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয়।
ইপিআই এর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মাওলা বক্স প্রথম আলোকে বলেন, কোনো একটি ওয়ার্ড বা গ্রামে তিনজন আক্রান্ত হলে তাকে প্রাদুর্ভাব বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই হিসাবে চলতি বছরের প্রথম চারমাসে সিরাজগঞ্জে দুটি এবং নওগাঁ, যশোর, রাঙ্গামাটিতে ও খাগড়াছড়িতে একটি প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুটি ঘটনায় নয় শিশু মারা যায়।
সামগ্রিক কর্মসূচিতেই অচলাবস্থা
শুধু যে এই কর্মসূচিটিই বাতিল হয়েছ, তা নয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিও (ইপিআই) হোঁচট খেয়েছে কোভিড-১৯ এর কারণে। ইপিআই কর্মসূচির আওতায় শিশুরা জন্মের প্রথম দিন যক্ষ্মারোধী বিসিজি টিকা পায়, এরপর দুইবছর বয়সের মধ্যে বাকি টিকাগুলো পেয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মুখে খাবার পোলিও, ধনুষ্টঙ্কার, ডিপথেরিয়া, হুপিংকফ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস বি, এক ধরনের নিউমোনিয়া, হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক। এই টিকার আওতাভুক্ত শিশু ৩৭ লাখ।
বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইপিআই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ২৫ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু করার পর থেকেই অভিভাবকদের আতঙ্ক, লকডাউনের কারণে গৃহবন্দী হয়ে থাকা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ব্যস্ততা ও যোগাযোগের অসুবিধার কারণে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে। ন্যাশনাল পোলিও ও মিজলস ল্যাব দেশে হাম পরীক্ষার একমাত্র ল্যাব। সেটিতে এখন কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা চলছে।
এ ছাড়া শিশু ও সেবাদানকারীদের সুরক্ষার জন্য লক ডাউন এলাকায় টিকা কার্যক্রম চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। যেসব জায়গায় লক ডাউন নেই, সেসব জায়গায় চলতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু অভিভাবকেরাই আসছেন না।
ঢাকার ভেতর ইপিআই কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকতা মো. শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় ২৮ টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঁচটি মাতৃসদন ও সূর্যের হাসি চিহ্নিত পারিবারিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক থেকে। স্থায়ী কেন্দ্রগুলো খোলা আছে, তবে টিকা নিতে আসছেন খুব কম। কতটা কমেছে সে সম্পর্কে তিনি বলতে পারেননি।
ঢাকা উত্তরের অবস্থাও একই। এনএনএসের লাইন ডিরেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের কারণে বহু পরিবারে শিশুরা যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না। সে কারণে ভিটামিন এ টা তাদের প্রয়োজন। আবার কোভিড-১৯ এর কারণে ভিটামিন এ খাওয়ানোর সময় জনসমাগম হওয়ার একটা আশঙ্কাও থেকে যায়। এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আছে, একদিনে কর্মসূচিটি পালন না করে কয়েকদিন ধরে করা।
মহামারির কারণে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পরপরই ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচও বলছে, মহামারির সময় যখন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন টিকা বা অন্য উপায়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। ২০১৪-১৫ সালে যখন ইবোলার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন হাম, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এইডস ও যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা ইবোলাকে ছাড়িয়ে যায়।
সমস্যা আরও
বুধবার ইউনিসেফ যে বিবৃতি দিয়েছে, এতে টিকা সরবরাহ নিয়েও সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিনের মজুদ বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে বিপজ্জনক মাত্রায় কমে গেছে। যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা ও ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভ্যাক্সিনের উৎপাদনও কমে গেছে।
ইপিআই কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মওলা বক্স বলেন, বাংলাদেশে হাম ও রুবেলার টিকা আসে কোপেনহেগেন থেকে। ভাড়া করা বিমানে টিকা আনার চিন্তা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত কথা হচ্ছে।
টিকাকেন্দ্র চলা নিয়ে বিতর্ক
ইউনিসেফ মনে করছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকাকেন্দ্রগুলো চালানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে শিশুদের স্বার্থে। শিশু বিশেষজ্ঞ আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত যে টিকাগুলো শিশুরা পেয়ে থাকে, সেই সূচিতে সপ্তাহ দুয়েকের দেরিতে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ঠিক মতো সেবা দিতে পারছে না, শিশুদের জন্য চিকিৎসা সেবা আরও অপ্রতুল।
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মহামারী শেষে ব্যাপকভিত্তিতে আগে হামের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও পরিকল্পনা এখনই চ'ড়ান্ত করা প্রয়োজন।