পুলিশের তৎপরতায় স্বস্তিতে পঞ্চগড়ের টমেটো চাষিরা
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে টমেটো বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন পঞ্চগড়ের গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষিরা। সময়মতো বিক্রি না হওয়ায় অনেকের উৎপাদিত টমেটো খেতেই পেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় এগিয়ে এসেছে পুলিশ। স্বস্তি মিলেছে চাষিদের মনে।
চাষিদের দূরবস্থা দেখে তৎপর হন পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উৎপাদিত টমেটো বিক্রির বিষয়ে কী করা যায়, তা আলোচনা করেন।
এরপর পঞ্চগড়ের পুলিশ শরীয়তপুর জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয় ৩৮ জন টমেটো ব্যবসায়ীকে। ওই ব্যবসায়ীদের জেলা শহরের একটি আবাসিক হোটেলে রাখা হয় ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে। কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ শেষ হলেই তাঁরা জেলার বিভিন্ন এলাকার টমোটো খেতগুলো ঘুরে টমেটো কিনবেন। তবে ইতিমধ্যে এসব ব্যবসায়ীর স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে জেলার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে টমেটো কিনতে শুরু করেছেন এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যবসায়ীদের যোগাযোগে ট্রাকে করে বিভিন্ন জেলায় টমেটো সরবরাহ শুরু হয়েছে।
এতে স্বস্তি ফিরেছে টমেটো চাষিদের মনে। লাভ না হলেও অন্তত উৎপাদন খরচ উঠানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তাঁরা।
গতকাল রোববার জেলার সদর উপজেলার বিভিন্ন টমেটো খেত ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগে যেসব টমেটো খেতে টমেটো পেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, সেখান থেকে শ্রমিকদের দিয়ে টমেটো সংগ্রহ করছেন চাষিরা। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা খেতে গিয়ে এসব টমেটো কিনে তাদের আড়তে পাঠাচ্ছেন। খেতগুলোর পাশে টমেটো স্তূপ করে বাছাই ও ওজন করা নিয়ে ব্যস্ত চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, পঞ্চগড় জেলায় প্রতি বছর গ্রীষ্মকালীন উন্নত জাতের (হাইব্রিড) টমেটো চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছিলেন চাষিরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পঞ্চগড়ে এসে আড়ত ভাড়া নিয়ে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তায় টমেটো কিনতেন। প্রতিদিন জেলা থেকে শত শত ট্রাকে ভরে এসব টমেটো ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো। চলতি মৌসুমে জেলায় ৯৩০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। ফলন ভালো হলেও করোনা পরিস্থিতিতে টমেটো বিক্রি করা নিয়ে বিপাকে পড়েন চাষিরা। বাইরের ব্যবসায়ীরা আসতে না পারায় এবং জেলায় উৎপাদিত টমেটো অন্য জেলায় সরবরাহ করতে না পারায় প্রতি মণ টমেটো মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। বিষয়টি জেলা পুলিশের নজরে এলে তৎপর হয় তারা। এখন টমেটোর দাম কিছুটা বেড়েছে। মান ভেদে প্রতি মণ টমেটো ২৪০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পঞ্চগড় উপজেলার সর্দারপাড়া এলাকার টমোটো চাষি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি দুই বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছি। এতে আমার খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। আশা করেছিলাম দুই বিঘায় ৫০০ মণ টমোটো বিক্রি করতে পারব। এবার ফলন ভালো হয়েছে। তবে এক সপ্তাহ আগে ৮০ থেকে ১০০ টাকা মণে বিক্রি দেখে হতাশ হয়েছিলাম। শুনেছি পুলিশ নাকি কিছু ব্যবসায়ীকে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এ জন্য এখন কিছুটা দাম বাড়তে শুরু করেছে। রোববার ৫০ মণ টমেটো বিক্রি করেছি ২৪০ টাকা মণ দরে। গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ টমেটো বিক্রি হয়েছিল ৩৮০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে। তারপরও ভালো। অন্তত খরচটা পাওয়া যাবে।'
স্থানীয় গলেহা এলাকার টমেটো ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বলেন, 'প্রতি বছর আমরা চাষিদের কাছ থেকে টমেটো কিনে বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। এতে চাষিদের পাশাপাশি আমরাও কিছুটা লাভবান হই। এবার করোনার কারণে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা আসতে না পারায় আমাদের ব্যবসাও হচ্ছিল না। পুলিশের সহযোগিতায় আমরা লাভবান হওয়ার আশা করছি। এখন চাষিদের কাছ থেকে টমেটো কিনে নিজেদের আড়তে রাখছি। পরে বাইরের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করব।'
প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা শরীয়তপুরের টমেটো ব্যবসায়ী চাঁন মিয়া মুঠোফোনে বলেন, 'আমি ২২ বছর ধরে পঞ্চগড় জেলায় টমেটো ব্যবসা করি। গত বছরও এখান থেকে আমি ৩০ হাজার মণ টমেটো কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেছি। এবার করোনাভাইরাসের কারণে সঠিক সময়ে আসতে পারিনি। পুলিশের বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের পঞ্চগড়ে আসার ৯ দিন হলো রোববার। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে অল্প পরিমাণে টমেটো কিনতে শুরু করেছি। আশা করছি আমরা খেতে গিয়ে টমেটো কিনতে শুরু করলে চাষিরা ন্যায্য দাম পাবেন।'
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হানিফ বলেন, লকডাউনের সময় পুলিশের এই উদ্যোগ টমেটো চাষিদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, লকডাউনে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে কৃষিপণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে না। সেই ভাবনা থেকে পঞ্চগড়ের চাষিরা টমেটো বিক্রি করতে পারছিলেন না। এখন সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। চাষিদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বিষয়ে যেকোনো সমস্যায় পুলিশ সব সময় সহযোগিতা করবে। পুলিশের এই উদ্যোগের পেছনে জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হানিফ সহযোগিতা করেছেন বলে তিনি জানান।