২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নাতনির সঙ্গে মধুর সময়

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাসে থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সকালে ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই নভেরা চলে আসে আমার কাছে। নভেরা আমার নাতনি। বয়স ১৫ মাসও হয়নি। আধো আধো বোলে দু–চারটা কথা বলতে শিখেছে। ওর শব্দভান্ডারের সঞ্চয় আপাতত এ রকম: নানা, মা, বাবা, নান, দিদা, মামা, সোহা, চাচা আর শাই। শাই মানে বাসায় ওর পরিচর্যাকারী মেয়েটা। নাম শরমিন। নভেরা ওর নামটা নিজের মতো সাইজ করে নিয়েছে। এ পর্যন্তই।

সকালে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেলে পানির মগ দেখিয়ে বলে, মাম মাম। মানে, পানি খাব। আমি মুখে তুলে দিলে খায়। এই তো কয়েক দিন আগেও দু–চার কদম হাঁটতে গেলে পড়ে যেত। ইদানীং একটু আত্মনির্ভর হয়েছে। একাই এঘর থেকে ওঘরে হেঁটে যায়। টানা বিশ–পঁচিশ কদম তো বেশ হাঁটতে পারে। এখন ভয়ংকর করোনা–কাল চলছে। সবাই গৃহবন্দী। নভেরার অতশত বোঝার বয়স হয়নি। ওর জন্য এখন মহাফুর্তি। মা–বাবা, আমরা নানা–নানি আর ওর মামা—সবাই একসঙ্গে আছি। দিনরাত আমাদের সঙ্গ পাচ্ছে। আমাদের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু সে। সবার এত অখণ্ড মনোযোগ সে কি আর পেয়েছে কখনো!

কিছুদিন ধরে দেখছি, নভেরা যখন আমার কাছে থাকে, তখন ওর দিকে মনোযোগ না দিয়ে মোবাইল ফোনে ফেসবুকে মগ্ন থাকলে ও খুব রেগে যায়। আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে অফ করে ছুড়ে ফেলে দেয়। ও মোবাইল ফোন অন–অফ করাও শিখে গেছে।

প্রতিদিন সকালে উঠে আমি বারান্দার ফুলগাছগুলোয় পানি দিই। খবরের কাগজ পড়ি। কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটা কার্টুনে দেখতে পেলাম, খাঁচার ভেতরে মানুষ আটকে আছে। মুখে মাস্কপরা। আর তাদের চারদিকে চিড়িয়াখানার বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার, ময়ূর আর অন্যান্য পশুপাখি মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের সত্যিই এখন এমনই অবস্থা। ভয়ে–আতঙ্কে সবাই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী।

এত বিরূপতার মধ্যেও সেদিন একটা খবর দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। দেখলাম, মানুষ ঘরে থাকায়, গাড়ি–ঘোড়া আর কলকারখানা বন্ধ থাকায় কার্বন নিঃসরণ খুবই কমে গেছে। দারুণ উন্নতি হয়েছে বৈশ্বিক পরিবেশের। গাছপালা নিবিড় ও সবুজ হয়ে উঠছে। এমনকি কক্সবাজারে আমাদের যে সমুদ্রসৈকতে কখনো ডলফিন দেখা যায়নি, সেখানে তটভূমির কাছেই এক দঙ্গল ডলফিন এসে হাপুস–হুপুস করছে। করোনাভাইরাসের প্রতাপে মনে হচ্ছে, প্রকৃতি তার ওপর আমাদের অন্যায় জবরদস্তির প্রতিশোধ নিচ্ছে। মানুষকে ঘরে পাঠিয়ে প্রকৃতি যেন তার আগের অবস্থা ফিরে পাচ্ছে, নিজের শুশ্রূষা নিজে করে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে, বাসযোগ্য রাখতে হবে।

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, তাতে মন খারাপ হয়ে যায়। এর মধ্যেও খবরে পড়লাম, ভারতের এক নারীবিজ্ঞানী করোনাভাইরাসের কিট বানিয়েছেন মাত্র দেড় মাসের প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রও কিট তৈরি করেছে। করোনা–কালের দুঃসময়ে এর সবই ভালো খবর। আমি কখনোই হতাশ হই না। ভেঙে পড়ি না। 

এসব খবরাখবরে পৃথিবীর খোঁজ রাখি। আর উপভোগ করি নাতনি নভেরার সঙ্গের উষ্ণতা। নভেরা মাঝেমধ্যে টিভির কাছে গিয়ে ইশারা করে বলে, চি চি ছাড়ো। চি চি মানে টম অ্যান্ড জেরি। ছাড়লে কিছুক্ষণ টিভি দেখে আবার উঠে গিয়ে অন্যত্র হাঁটাহাঁটি করে। আশা রাখছি, এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠে পৃথিবী আবারও নভেরার মতো হাঁটি হাঁটি পা পা করে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে।