শরীয়তপুরের ৬ হাসপাতালে চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট
শরীয়তপুর জেলায় পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা শহরে ১০০ শয্যার হাসপাতাল আছে। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট আছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ ধরনের সংকট বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে চিকিৎসকদের আশঙ্কা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বহন করার জন্য জেলায় তিনটি বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত করার নির্দেশ থাকলেও শরীয়তপুর স্বাস্থ্য বিভাগ একটি অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত করতে পারেনি। মোটরসাইকেলে করে গ্রামে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হচ্ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাজিরার এক চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে জাজিরা থেকে ঢাকার কুর্মিটোলায় পাঠানো হয়েছে। ওই রোগীকে বহনের জন্য বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। স্বাস্থ্য বিভাগের অন্য অ্যাম্বুলেন্সও পাঠানো সম্ভব হয়নি। তখন রোগীর স্বজনেরা ১২ হাজার টাকায় ঢাকা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আনেন। রোগীর গরিব স্বজনদেরও ওই টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
শরীয়তপুর স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত শরীয়তপুরে ছয়জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় তিনজন, জাজিরায় দুজন ও ডামুড্যায় একজন। আর নড়িয়ার এক বাসিন্দা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। এখন পর্যন্ত শরীয়তপুরে ১০৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মধ্যে ৮০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। ছয়জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এখনো ২৩ ব্যক্তির নমুনার ফলাফল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে শরীয়তপুর স্বাস্থ্য বিভাগে পাঠানো হয়নি।
শরীয়তপুরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার সিলিন্ডারের ফ্লমিটার, এক্স–রে মেশিন, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন, নেবুলেইজার মেশিন সংকট রয়েছে।
জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ১২টি সিলিন্ডার থাকলেও ওইগুলো ব্যবহারের ফ্লমিটার আছে ৪টি। একসঙ্গে চারজন রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হবে। নেবুলেইজার মেশিন আছে দুটি। এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি মেশিন চালু নেই।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ১২টি সিলিন্ডার থাকলেও ওইগুলো ব্যবহারের ফ্লমিটার আছে ৩টি। একসঙ্গে তিনজন রোগীকে অক্সিজেন দিতে পারে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। নেবুলেইজার মেশিন আছে দুটি। হাসপাতালটিতে এক্স–রে, ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নেই।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ১৪টি সিলিন্ডার থাকলেও ওইগুলো ব্যবহারের ফ্লমিটার রয়েছে ৩টি। একসঙ্গে তিনজন রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া যায়। নেবুলেইজার মেশিন আছে দুটি। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে এক্সরে, ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নেই।
ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ১২টি সিলিন্ডার আছে। ওই সিলিন্ডার থেকে রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার যন্ত্র ফ্লমিটার আছে ২টি। নেবুলেইজার মেশিন আছে তিনটি। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নেই।
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ৮টি সিলিন্ডার আছে। সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন সরবরাহের ফ্লমিটার আছে ৪টি। একসঙ্গে চারজন রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া যায়। নেবুলেইজার মেশিন আছে দুটি। ৫০ শয্যার ওই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে এক্স–রে, ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নেই।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যার। এই হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকে অনেক বেশি। বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও সদর হাসপাতালে রোগী পাঠানো হয়। সদর হাসপাতালে অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছে ৬০টি। এগুলো ব্যবহারের ফ্লমিটার আছে ১০টি। প্রত্যেক ওয়ার্ডে দুটি করে সিলিন্ডার বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়ার কথা থাকলেও ফ্লমিটারের সংকটের কারণে তা দেওয়া হয়নি। রোগীর চাপ বেশি থাকলে তখন এক ওয়ার্ডেরটা আরেক ওয়ার্ডে নিয়ে ব্যবহার করতে হয়। জেলার বড় এই হাসপাতালের ইসিজি মেশিনটি নষ্ট দীর্ঘদিন ধরে। নেবুলেইজার আছে ৮টি। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও তা চালানোর টেকনেশিয়ান নেই। হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক ওই মেশিনে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেননি।
৯ এপ্রিল বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও পা ফুলে যাওয়ায় এক যুবককে সদর হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ওই রোগীর ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করার প্রয়োজন হলে তা হাসপাতাল থেকে করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনীর আহমেদ খান শহরের বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে অনুরোধ করেন ওই দুটি পরীক্ষা করে দিতে। কিন্তু করোনভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন সন্দেহে কেউ রাজি হননি। পরের দিন ওই যুবক আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যান।
জানতে চাইলে মুনীর আহম্মেদ খান বলেন, ‘নানা সংকটের মধ্য দিয়েই আমরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। আর যেসব চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট আছে, তা চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
শরীয়তপুর সদর উপজেলার এক পরিবারের তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন ১১ মার্চ। ওই তিনজনকে বাড়িতেই রাখা হয়েছে। তাঁদের খোঁজখবর রাখা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মী এস এম মোক্তার হোসেনকে। তিনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী না পেয়ে রেইনকোট আর হেলমেট পরে ওই গ্রামে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ওই তিনজনসহ চার ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহের সময় আমি দলের সঙ্গে ছিলাম। তখন একটি পিপিই দেওয়া হয়েছিল। ওই তিন ব্যক্তি করোনভাইরাসে আক্রান্ত জানার পর পিপিই ফেলে দিই। এরপর আর আমাকে পিপিই দেওয়া হয়নি। ওই রোগীদের খোঁজ নিতে এবং নতুন ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহের জন্য গ্রামে যেতে হচ্ছে। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে রেইনকোট ও হেলমেট পরে যাই।’
জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকট প্রকট। এ রকম একটি দুর্যোগের সময় চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আমরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে করতে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত। স্বাস্থ্যকর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করে তা মোটরসাইকেলে করে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন।’
শরীয়পুরের সিভিল সার্জন আবদুল্লাহ আল মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বহনের জন্য আপাতত সদর হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হবে। যেহেতু এখনো শরীয়তপুরের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়নি, তাই অ্যাম্বুলেন্সও সেভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করা হবে। আর চিকিৎসাসামগ্রীর কিছু সংকট আছে। চাহিদা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী যারা আক্রান্ত রোগীর কাছাকাছি যান, তাদের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি গাড়ি দিয়েছে, যা দিয়ে নমুনা ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে এই মুহূর্তে গাড়ি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।’