খাদ্য মজুত ভালো, চিন্তা সরবরাহ আর কেনার ক্ষমতা নিয়ে
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে বিশ্বের বেশির ভাগ খাদ্যের দাম কমেছে। কিন্তু উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। এখানে প্রধান খাদ্য চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যদিও অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় সরকারের কাছে খাদ্যের মজুত বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞদের প্রধান চিন্তা দেশের বাজারে খাদ্যের সরবরাহ নিয়ে। পাশাপাশি সেই খাদ্য কেনার মতো অর্থ দেশের সাধারণ মানুষের থাকবে কি না, এ নিয়েও তাঁরা চিন্তিত। তাঁদের বক্তব্য, এ কাজ শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। বেসরকারি সংস্থাগুলোর ক্ষমতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে।
এক মাস ধরে সরু ও মাঝারি চালের দাম বাড়ছিল। এবার বাড়তে শুরু করেছে মোটা চালের দাম। গত এক সপ্তাহে দেশে মোটা চালের কেজি ৪০ পেরিয়ে ৪২ টাকায় পৌঁছেছে। আর সরু চালের দর তো সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে এক মাসে ১২ শতাংশ বেড়েছে, কেজি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামকে প্রায় লকডাউন করে ফেলেছে। জরুরি খাদ্যপণ্য ছাড়া কোনো যানবাহন ওই দুই প্রধান শহরে ঢুকতে পারছে না। দেশের ধান-চালের প্রধান দুই সরবরাহকারী জেলা কুষ্টিয়া ও নওগাঁ থেকে দুই শহরে চাল সরবরাহের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। চালকলের মালিকেরা নতুন বোরো ধান এখনো কেনা শুরু করেননি। বেশির ভাগ চালকল বন্ধ রয়েছে।
এ তো গেল শুধু চালের ব্যাপার। তবে এফএও সম্প্রতি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের কী ধরনের খাবার খেতে হবে আর হবে না, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে অবশ্য ভাতের কথা নেই। বলা হচ্ছে, এই সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাজা শাকসবজি, মাছ, ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলমূল, পানিসহ নানা পুষ্টিকর খাবার বেশি বেশি করে খেতে হবে। কিন্তু বিশ্বের একটা বড় অংশে যাতায়াত সীমিত হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ খাদ্য পাবে কোথা থেকে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা।
অন্যদিকে করোনার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রি। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলেছে, করোনার কারণে বিশ্বে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে গত সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ওই প্রতিবেদনটি লিখেছেন।
খাবার কিনে খাওয়া মানুষের বিপদ বেশি
উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য সরবরাহব্যবস্থায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব নিয়ে ইফপ্রি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। এসব দেশে খাদ্য মজুত যত ভালোই থাকুক না কেন, গরিব মানুষের কাছে যদি পর্যাপ্ত খাদ্য পৌঁছানো না যায়, তাহলে কোনো লাভ নেই। কেননা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ বাজার থেকে খাবার কিনে খায়। তার মানে বাজারে যদি স্বল্পমূল্যে খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এসব দেশের দরিদ্র মানুষ খাদ্য নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে।
ইফপ্রির ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ খাদ্য এখন করপোরেট শিল্পগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে খাদ্য সহজে পৌঁছাবে না। করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পরও খাদ্য নিয়ে সংকট থেকে যাবে। ফলে এসব উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে সঠিকভাবে এগোতে হবে। নয়তো দেশগুলোর বিপুল জনগোষ্ঠী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়বে।
মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
গত সোমবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে প্রকাশিত ‘কোভিড-১৯: বাংলাদেশের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে’ শীর্ষক লেখাটিতে ওই আশঙ্কার পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি ছুটি ও লকডাউনের কারণে শুধু ঢাকা শহরের এক কোটি মানুষের জীবিকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ওই মানুষগুলোর বেশির ভাগ রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাঁদের মাত্র ১৫ শতাংশের আয় দিনে ৫০০ টাকার বেশি। বাকিদের আয় তার চেয়ে কম। ন্যূনতম ৫০০ টাকা আয় না হলে ঢাকায় একটি পরিবার ন্যূনতম খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্যজনিত ছুটি ও ৯০ শতাংশের বিমা আছে। সেখানে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁদের কোনো বিমা বা ছুটি নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে এসব মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ ব্যাপারে আসিফ সালেহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় লকডাউনের যে ধারণা দেওয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে কার্যকর হবে না। কারণ, ওই ধারণাটি ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা দেশের বেশির ভাগ মানুষ নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকে। ফলে তাদের জন্য লকডাউন মানাটা সহজ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে বিপুল জনসংখ্যার ঘনত্ব, বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এখানে লকডাউন দিলে কী হয়, তা লাখো মানুষের দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি ফেরা, আবার তৈরি পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় একইভাবে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে আমাদের পুরো শহর বা জেলাকে লকডাউন না করে করোনা সংক্রমণের হটস্পটগুলো লকডাউন করতে হবে। আর লকডাউনে থাকা মানুষদের বাড়িতে খাদ্য বা নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে মানুষ বাড়িতে থাকতে পারবে।’
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি কারও মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দিলে সে স্থানীয়ভাবে আরও বেশি নিগৃহীত হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের বেশির ভাগ করোনা সংক্রমণপ্রবণ এলাকায় কমিউনিটিভিত্তিক দল তৈরি করতে হবে। তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা করোনা রোগী চিহ্নিত করে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিতে পারে। এই উদ্যোগগুলো না নিয়ে এখন যেভাবে চলছে, তা চলতে থাকলে দেশে দ্রুত মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।’
অন্যদিকে গত ৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গ্লোবাল থেকে ‘গ্লোবাল রেসেলিয়ানস ইনডেক্স-২০১৯’ বা বৈশ্বিক সহিষ্ণুতা সূচক-২০১৯ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে বিবিসির খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সংকট কোনো দেশ কত ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, তা বোঝা যাবে ওই ইনডেক্স বা সূচকটি খেয়াল করলে। সেখানে দেখা গেছে, ১৩০টি দেশের মধ্যে ওই সূচক অনুযায়ী শীর্ষ তিনটি দেশ হচ্ছে নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ড। আর ওই তালিকায় সবার নিচের দিকে থাকা তিনটি দেশ হচ্ছে হাইতি, ভেনেজুয়েলা ও ইথিওপিয়া।
বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে ১৩০টি দেশের মধ্যে ১০৬। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ৫৮ ও ৮১। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশের রেজেলিয়ান্স বা সহিষ্ণুতার ক্ষমতা কম। ওই সূচক তৈরি করা হয়েছে মূলত দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, করপোরেট সুশাসন ও ব্যবসার পরিবেশকে আমলে নিয়ে। এই বিষয়গুলো যে দেশে ভালোমতো চলছে, সেই দেশের পক্ষে করোনাভাইরাসের মতো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতের চাপ সহ্য করার সক্ষমতা তত বেশি থাকবে।
বাংলাদেশ কী করছে
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে করোনা সংক্রমণের কারণে শুরু হওয়া খাদ্যসংকট মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশের অন্য সাধারণ দুর্যোগকালে সচরাচর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সরকার সেগুলোই আস্তে আস্তে চালু করা শুরু করেছে। প্রতিটি জেলায় ৫ লাখ করে টাকা ও ৫০০ টন চাল দেওয়া হয়েছে। দুই লাখ প্যাকেট খাবার তৈরি রাখা হয়েছে। আর ৫০ লাখ মানুষের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা হবে।
অন্যদিকে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে এই সময়টাতে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) চালু করা হয়। সরকার কার্যক্রমটি করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা ঢেলে সাজিয়েছে। প্রতি কেজি চালের দর ৩০ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ টাকা করেছে। রাজধানীতে দুই লাখ বস্তিবাসী পরিবারের কাছে সপ্তাহে তিনবার ৫ কেজি করে ওই চাল বিক্রি করা হবে। এই কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর প্রতিটি ওএমএস ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি লেগে আছে। প্রথম দুই দিনেই অনেক ক্রেতা চাল কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরে গেছেন।
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে গ্রামীণ পর্যায়ে বোরো ধান-চাল কেনার মধ্য দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটি থেকে ৬ লাখ টন ধান ২৬ টাকা কেজি দরে আর ১০ লাখ টন চাল ৩৬ টাকা কেজি দরে কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে ধান-চাল কেনা শুরু হবে বলে জানিয়েছে তারা। এর বাইরে তারা করোনা পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে নতুন কোনো কর্মসূচি নিচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ওএমএস চালের জন্য যাঁরা লাইন ধরছেন, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ একই পরিবারের একাধিক সদস্য। অনেকে কম টাকায় ওই চাল কিনে আবার বিক্রি করছেন। তাই আমরা বুঝেশুনে ওএমএসের চালের পরিমাণ বাড়াব। আর গ্রামের কৃষকদের কাছে দ্রুত যাতে নগদ অর্থ যায়, সে জন্য আমরা দ্রুত ধান-চাল কেনা শুরু করব।
তবে নীতি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণের ফলে যে আর্থসামাজিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা অন্য আট-দশটা সমস্যার সমাধানের আলোকে এগোলে সরকার ভুল করবে। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় খাদ্য উৎপাদন ভালো হয়েছে, লাখ লাখ টন খাদ্য গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে—এমন সব কথা বললে সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে অমর্ত্য সেনের দুর্ভিক্ষ নিয়ে করা গবেষণার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বেশি উৎপাদন হলেই হবে না। খাদ্য মানুষের কাছে যাচ্ছে কি না এবং তাদের সেটা কেনার মতো সামর্থ্য আছে কি না, তা দেখতে হবে। আর সেই কাজ শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে এগোতে হবে। আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে।