পটিয়া পিটিআইয়ে দিনের পর দিন যৌন হয়রানির শিকার নারীরা
প্রাথমিক শিক্ষকদের পাঠদান ও নীতিনৈতিকতা বিষয়ে শিক্ষা দেয় প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)। সেই পিটিআইয়ে নারী প্রশিক্ষণার্থীরা দিনের পর দিন চার প্রশিক্ষকের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অন্তত ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী পটিয়া পিটিআইতে এভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ এক প্রশিক্ষক তাঁর চার সহকর্মীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন। বিচার না পেয়ে কোনো উপায় না দেখে তিনি ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি লিখে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। গত শুক্রবার রাতে প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়ার আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনার পর নারী নির্যাতনের এমন ঘটনা সামনে আসে। এতে ফুঁসে ওঠেন দীর্ঘদিন মুখ বন্ধ করে রাখা প্রশিক্ষণার্থীরাও।
শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দেবব্রত। দুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গতকাল রোববার তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন।
গতকাল বাসায় ফিরে মুঠোফোনে দেবব্রত অসহায়ত্ব প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের সামনে প্রশিক্ষণার্থীদের ওপর চার সহকর্মী যৌন হয়রানি করে যাচ্ছিলেন। আমি কিছু করতে পারছিলাম না। শিক্ষার্থীরা অনেকে আমার কাছে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁরা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছিলেন না। আমি প্রতিবাদ করেও কিছু করতে পারিনি। তাই শেষে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলাম। জীবনের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম।’
পিটিআইতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের দেড় বছরের প্রশিক্ষণ হয়। এর মধ্যে এক বছর পিটিআইতে থাকেন তাঁরা। সেখানে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। আর ছয় মাস বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠদান করে থাকেন। প্রতি ব্যাচে ২০০ জন প্রশিক্ষণার্থী থাকেন। তবে পটিয়া পিটিআইতে এখন ১৫০ জনের মতো প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন।
আন্দোলনের মুখে গতকাল চার প্রশিক্ষককে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন শরীরচর্চার প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন, চারু ও কারুকলার সবুজ কান্তি আচার্য, সাধারণ বিভাগের জসিম উদ্দিন ও আইটির রবিউল ইসলাম। পাশাপাশি যৌন হয়রানির ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগমকে।
আন্দোলন ও শাস্তি
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগম ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে পটিয়া পিটিআইতে উপস্থিত হন। কিন্তু প্রশিক্ষণার্থীরা চার প্রশিক্ষকের শাস্তি এবং আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হননি।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রশিক্ষণার্থীরা পিটিআই মাঠে বসে আছেন। তাঁরা কেউ ক্লাসে যাননি। কেউ কেউ স্লোগান দিচ্ছিলেন। সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগমের আশ্বাস মানছিলেন না তাঁরা। অভিযুক্ত চারজনের শাস্তি ও বরখাস্ত চেয়ে তাঁরা বিক্ষোভ করতে থাকেন।
দুপুরের পর চট্টগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক সুলতান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পটিয়া পিটিআইতে গিয়ে অভিযুক্ত চারজন প্রশিক্ষককে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। এ সময় আন্দোলনরত প্রশিক্ষণার্থীরা বলেন, শুধু তাঁদের বদলি নয়, কোথাও কোনো পিটিআইতে তাঁরা চাকরি করতে পারবেন না। তাঁদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানান তাঁরা।
সোলতান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত চারজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ইনস্ট্রাক্টর দেবব্রত বড়ুয়া ও আন্দোলনরত প্রশিক্ষণার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর প্রশিক্ষণার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে সম্মত হন।
উপপরিচালকের সঙ্গে এ সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ও পিটিআইয়ের তত্ত্বাবধায়ক তপন কুমার দাশ উপস্থিত ছিলেন।
পিটিআইতে যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তপন কুমার দাশ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ তিনি আগে শোনেননি। কেউ কেউ লিখিত অভিযোগও দেয়নি। শনিবার বিষয়টি জেনেছেন।
শনিবার দেবব্রতের আত্মহত্যার চেষ্টার খবর জানাজানি হলে এর প্রতিবাদে প্রশিক্ষণার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে পিটিআইতে মানববন্ধন করেন। একাধিক প্রশিক্ষণার্থী প্রথম আলোর কাছে যৌন হয়রানির ঘটনা স্বীকার করেছেন।
অভিযোগ ও অভিযুক্তদের কথা
দেবব্রত বড়ুয়ার খোলা চিঠিতে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, প্রায় ৫০ নারী প্রশিক্ষণার্থী তাঁদের হাতে যৌন হয়রানির অভিযোগ স্বীকার হয়েছেন।
এর মধ্যে ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১১ সালে তিনি পিটিআইতে বদলি হয়ে আসার পর প্রশিক্ষণার্থী ছাত্রীদের উদ্দেশে বিভিন্নভাবে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ শুরু করেন। কাউকে বেশি নম্বর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, কারও প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এ অপকর্ম করে আসছিলেন তিনি।
জসিম বিরতির সময় নারী প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষ, করিডোর ও আঙিনায় কথা বলতেন এবং সম্পর্ক তৈরি করে পরবর্তী সময়ে ‘অপকর্ম’ করতেন।
সবুজ চারু ও কারুকলার প্রশিক্ষক হিসেবে মেয়েদের অঙ্গসৌষ্ঠবের শৈল্পিক বিশ্লেষণ এবং শাড়ি বা কী ধরনের পোশাকে কাকে ভালো দেখাবে, সে পরামর্শ দিতেন।
রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক নারী প্রশিক্ষণার্থীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিয়ে না করে জটিলতা তৈরি করেন।
দেবব্রত বড়ুয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে ফারুক হোসেন বলেন, ব্যক্তিগত আক্রোশে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। ফারুক বলেন, ‘ফেসবুকে মিথ্যা অভিযোগ করে মানহানি করায় আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দেব।’
অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও সবুজ আচার্য তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। এটা ষড়যন্ত্রমূলক।’
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যে চারজনের কথা বলা হচ্ছে, সেই চারজনকে আপাতত ওই পিটিআইয়ের কর্ম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রাথমিকের উপপরিচালককে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।