জামায়াত ভোটেও নেই, মাঠেও নেই
ভোটের রাজনীতি থেকে আপাতত নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে তাদের লক্ষ্য চুপচাপ থেকে দলের কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত রাখা। নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রশাসনের নজরদারির পাশাপাশি দলের সংস্কারপন্থীদের নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা চাপে আছেন। এ অবস্থায় ভোটের মাঠে নেমে জামায়াত নতুন করে সরকারের দৃষ্টিতে পড়তে চাইছে না।
ফলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মতো ২১ ও ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদের পাঁচটি উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জামায়াত থাকছে না। এমনকি জোটসঙ্গী বিএনপির প্রার্থীদের জন্যও নামছেন না জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। দলটির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, সিদ্ধান্ত নিয়েই জামায়াত ভোট-রাজনীতি থেকে বিরত থাকছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে অন্তত ভোটের দিন হলেও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। কিন্তু জামায়াত মাঠে নামেনি। বরং কেন্দ্রীয়ভাবে নেতা-কর্মীদের ভোটের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়।
এ বিষয়ে জামায়াতের দুজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ কারণে ঢাকা সিটির নির্বাচনের আগে কেন্দ্র থেকে ঢাকা মহানগরীর নেতা-কর্মীদের প্রতি বার্তা ছিল, কেউ যদি ভোটের মাঠে থেকে মামলা-হামলার শিকার হন, দলীয়ভাবে তাঁর দায়িত্ব নেওয়া হবে না।
জানা গেছে, সামনের নির্বাচনগুলোর ব্যাপারেও জামায়াত আগের সিদ্ধান্তেই আছে। ফলে সংসদের আসন্ন পাঁচটি উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেও ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতকে পাশে পাচ্ছে না বিএনপি।
জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর দুই কমিটির একটির আমির নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ভোটের যে অবস্থা, তাতে অংশ নিয়ে অর্থের অপচয় আর নতুন করে মামলার আসামি হওয়া ছাড়া কোনো লাভ নেই। যখন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে আসবে, তখন জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াতের অপর একটি সূত্র জানায়, কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোই নয়, পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমেও একটু ধীরে চলার কৌশল নিয়েছেন দলের নতুন নেতৃত্ব। গত ডিসেম্বরে জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল পদে আসেন যথাক্রমে শফিকুর রহমান ও মিয়া গোলাম পরওয়ার। নতুন এই কমিটির নেতারা মনে করছেন, সবকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। শিগগির পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার লক্ষণও নেই। তাই এ সময়টাতে চুপচাপ থেকে কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত রাখার কৌশলকে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এ ছাড়া সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতাদের একটি অংশ দল থেকে বের হয়ে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে যে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা নিয়েও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা অস্বস্তিতে আছেন। এরই মধ্যে জামায়াতের পেশাজীবী ফোরামের সভাপতি ও সাবেক সচিব এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী এবং রংপুর অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবু হেনা এরশাদ হোসেনসহ দলের অনেক সাবেক-বর্তমান নেতা ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-এ যুক্ত হয়েছেন। নতুন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন জেলায় সফর করছেন, কর্মশালা করছেন, যার প্রভাব পড়ছে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর। যদিও জামায়াতের নেতারা তা স্বীকার করতে চান না।
অবশ্য জামায়াত নির্বাচন বয়কট করলেও তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র দল বিএনপি অবস্থান বদলে নির্বাচনে ফিরে এসেছে। কয়েকটি নির্বাচন বর্জন করে আবার সংসদ ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ পর্যন্ত শুধু বগুড়ায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শূন্য আসনে জেতা ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই বিএনপির। তবু ভোটের মাঠে থাকাটাকে উপকারী মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
>ঢাকা সিটি নির্বাচনে অন্তত ভোটের দিন জামায়াতের নেতা-কর্মীদের পাওয়ার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। কিন্তু তাঁরা মাঠে নামেননি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, টানা প্রায় এক যুগ ধরে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে না পারায় নতুন প্রজন্ম ‘বিএনপি ও ধানের শীষের’ স্লোগানই ভুলতে বসেছে। নির্বাচনে থাকলে দল আলোচনায় থাকবে, পাশাপাশি জনগণের কাছে গিয়ে সরকারি দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। একই সঙ্গে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে যে সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে, সেটিও জনগণের কাছে সরাসরি তুলে ধরা সম্ভব হয় নির্বাচনে। তা ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নতুন উপায়ে ‘ভোট কারচুপি’ করছে, যা ভেতরে-ভেতরে মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। একদিন না একদিন মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়াকেই আমরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মনে করছি। কারণ, নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ নেই, হওয়া উচিত নয় বলে মনে করে বিএনপি।’
অবশ্য জামায়াতের নেতারা দাবি করেন, জামায়াত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বাস্তব পরিস্থিতির কারণে। তাঁরা মনে করেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীন নির্বাচনে অংশ নেওয়া অর্থহীন। এতে অর্থের অপচয় এবং নতুন করে হামলা-মামলায় জড়ানো ছাড়া কোনো অর্জন করার কিছু নেই।