চট্টগ্রাম সিটিতে কিশোর গ্যাংয়ের সাত গডফাদার কাউন্সিলর প্রার্থী
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে পরিচিত অপরাধী চক্রের সাত পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থক। আলোচিত এই সাতজনের মধ্যে দুজন সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থী। বাকি পাঁচজন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। তাঁদের একজন কারাগারে বসেই নির্বাচন করছেন।
বিভিন্ন এলাকার কিশোর অপরাধী চক্রের কথিত ‘গডফাদার’ বা ‘বড় ভাইয়েরা’ জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াইয়ে নামায় নির্বাচনের পরিবেশ অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে নাগরিক সমাজ।
তবে র্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জানান, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়ে র্যাব সতর্ক রয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কিশোর অপরাধী চক্রের (কিশোর গ্যাং) ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক বা নেতার তালিকা করে। তাঁদের মধ্যে সাতজন চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁরা হলেন নূর মোস্তফা ওরফে টিনু, এসরারুল হক, আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল, দিদারুল আলম মাসুম, সাবের আহম্মদ, জহুরুল হক ওরফে জসিম ও ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ক্লিন ইমেজের লোকজনকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দলের মনোনয়ন পাওয়াদের মধ্যেও দুজন কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক—এ কথা জানালে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, রাজনীতি করার কারণে অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতেই পারে।
২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের জন্য কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২২০ জন।
কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে যুবলীগ নামধারী নূর মোস্তফা ওরফে টিনুকে অস্ত্রসহ গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর র্যাব গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার পাঁচটি মামলা রয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী টিনুর অনুসারীরা বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ ও চকবাজার এলাকায় সক্রিয়। তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত। তাঁর দলের সদস্যদের বড় অংশ কিশোর–তরুণ। বাকলিয়ায় গত বছরের ৬ এপ্রিল এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে কিশোরদের দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া হয়। সেই ঝগড়া মেটাতে গিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী লোকমান নিহত হন টিনুর সহযোগী সাইফুল ইসলামের গুলিতে। অবশ্য দুই দিন পর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ওই সাইফুলও নিহত হন।
এই নূর মোস্তফা ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের (চকবাজার এলাকা) কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে কারাগার থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁর মুক্তি দাবি করে এবং কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে চান জানিয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারও সাঁটানো রয়েছে।
>চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন। পুলিশের তালিকাভুক্ত তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। দুজনকে দলের সমর্থন দেওয়া হয়। বাকি পাঁচজন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’।
র্যাব–৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক নুর মোস্তফার কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করা দুঃখজনক। অস্ত্র মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে আছেন।
আরেক কাউন্সিলর প্রার্থী যুবলীগ নামধারী এসরারুল হকের নেতৃত্বে একাধিক অপরাধী চক্র নগরের বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, শমশেরপাড়া, কালুরঘাট ও পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয়। জায়গাজমি দখল, নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গত বছরের ৫ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে আমজাদ হোসেন নামের একজনের পায়ে ছিদ্র করে দেয় এসরারুলের অনুসারীরা।
১৪ নম্বর ওয়ার্ডে (লালখান বাজার) কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল। তাঁর বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে।
আবুল হাসনাত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কলেজছাত্র দিদার হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম বাদ দেয় পুলিশ। নিহতের পরিবার নারাজি আবেদন করলেও অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করা হয়। ওই হত্যা মামলায় ১৪ কিশোর জড়িত থাকার তথ্য পায় পুলিশ, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭। বেশির ভাগ বস্তির বাসিন্দা।
তবে আবুল হাসনাত প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি স্বচ্ছ রাজনীতি করেন। এ কারণে দল তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে।
দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম। তিনি ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি। দিদারুল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সুদীপ্ত হত্যা মামলায় তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়ানো হয়েছে। তিনি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত নন।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের (উত্তর পাহাড়তলী) বর্তমান কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ। তাদের ব্যবহার করে এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এমন ঘটনায় করা মামলার আসামিও তিনি। তবে এবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। জহুরুল আলমও দাবি করেন, এলাকায় তাঁর কোনো কিশোর গ্যাং নেই।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডে (পাহাড়তলী) আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে গত বছরের ২৬ আগস্ট জাকির হোসেন নামের দশম শ্রেণিপড়ুয়া তাঁর এক অনুসারী প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীও দাবি করেন, তিনি দীর্ঘদিন স্বচ্ছতার সঙ্গে রাজনীতি করছেন।
১২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও সরাইপাড়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবের আহম্মদ এবার আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি। তিনিও ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে লড়ছেন। তিনি গত বছরের ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া আরেকটি হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। কিশোর গ্যাং পরিচালনা ও সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে সাবের আহম্মদের দাবি, ‘সব অপপ্রচার’।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সৎ ও জনকল্যাণে আগ্রহী ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হলে ভোটাররা উপকৃত হবেন। অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকেরা জনপ্রতিনিধি হলে অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকেরা নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তাঁরা যাতে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করতে না পারেন, সে জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে। তাঁদের নজরদারিতে রাখা হবে। বিন্দুমাত্রও সুযোগ দেওয়া হবে না।