আপাতত ভাসানচরে যাচ্ছে না রোহিঙ্গারা
>আইসিজের রায়ের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে চায় না সরকার।
কক্সবাজারের শিবির থেকে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা ভাবছে সরকার। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণেই মূলত সরকার রোহিঙ্গাদের আপাতত সেখানে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধে গত ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) রায়ের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠিয়ে সরকার সমালোচনার মুখে পড়তে চায় না।
পররাষ্ট্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে অন্তত ৫৫টি বিষয় সুরাহা করা উচিত বলে মতামত দিয়েছিল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো। এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা। তাদের নিরাপত্তা, খাবারের সরবরাহ, চিকিৎসাসেবাসহ জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। নৌপথে ভাসানচরে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করতে বলেছে উন্নয়ন সংস্থাগুলো। নোয়াখালী বা হাতিয়া থেকে ভাসানচরে সরাসরি নৌযাগাযোগের কোনো ব্যবস্থা এখন নেই। মেঘনা নদীর যে এলাকায় ভাসানচর, তা কোনো নৌপথের অন্তর্ভুক্ত নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাসানচরে জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থার জন্য দপ্তর নির্মাণের কথাও বলেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ভাসানচরকে নিরাপদ ও বাসোপযোগী করতে যে ৫৫টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সরকার তার ৪৫টি নিশ্চিত করতে পেরেছে। এই অবস্থায় সব কাজ শেষ না করে রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না।
এদিকে ভাসানচরের অবকাঠামো নির্মাণ পরিস্থিতি দেখতে ১৩ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এরপরই ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর থেকে সরকার আপাতত সরে আসছে এমন আলোচনা শুরু হয়।
এ বিষয়ে এনামুর রহমান গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া ভাসানচরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য খাবার, স্বাস্থ্যসেবাসহ জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করাটা কঠিন। এখন পর্যন্ত ভাসানচর নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি দূর হয়নি। তাই আপাতত ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্থগিত করার কথা ভাবছি। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা থেকে সরকার সরে আসছে কি না, ১৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকেরা এই প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তবে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো হলে ভবিষ্যতে তারা ওই জায়গা না–ও ছাড়তে পারে। আমরা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে চাই। এটাই আমাদের অগ্রাধিকার।’
ভাসানচরে মোট খরচ
নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার–জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাড়তি টাকা ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে। বরাদ্দ বাড়ার ফলে ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হবে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশী দেশের বাস্তুচ্যুত লোকজনকে স্থানান্তর করাটা আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। তবে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া অংশীজনদের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনা ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয়।
গতি নেই প্রত্যাবাসনে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকার আশাবাদের কথা শোনালেও বাস্তবতা ভিন্ন। প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে মধ্যস্থতা করার ঘোষণা দিয়েছিল চীন। ওই মাসেই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে জাতিসংঘের মহাসচিবের উপস্থিতিতে তিন দেশের (বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন) কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি হয়। প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে কী কী কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করার কথা ওই কমিটির। গত ছয় মাসে দুবার আনুষ্ঠানিক এবং আরও একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে করেছে কমিটি। তবে চীন বারবার চেষ্টা করেও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের কক্সবাজারে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ঢাকায় পররাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মিয়ানমার দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল চীন। শেষ পর্যন্ত ওই বৈঠকেও আসেননি মিয়ানমারের প্রতিনিধি। এমন এক পরিস্থিতিতে চীনের মধ্যস্থতায় খুব শিগগির প্রত্যাবাসন শুরু হবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন–পীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরের কয়েক মাসে প্রাণ বাঁচাতে অন্তত সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরের দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে আরও ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।