পানিসংকটে চাষির হাহাকার
এত দিনে বোরো ধানের চারা রোপণ শেষ হওয়ার কথা। রোপণ করা ধানের খেতে পানিও থাকার কথা। কিন্তু পানি না থাকায় অনেক জমিতে এখনো হাল চাষ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেক জমিতে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। যেসব জমিতে ধানের চারা রোপণ করা শেষ হয়েছে পানির অভাবে সেগুলোর তলা শুকিয়ে ফেটে গেছে। ধান রোপণের সময় ফুরিয়ে আসায় পানির জন্য কৃষকেরা অস্থির হয়ে উঠেছেন।
মনু নদ সেচ প্রকল্পের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় শাখা সেচ খাল সংস্কার না হওয়ার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শাখাখাল ঘাসে ভরে গেছে। এতে খালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পানি গিয়ে পৌঁছাতে পারছে না। কোথাও ইঁদুরের গর্ত দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়ায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও বাঁধ ক্ষয়ে নিচু হয়ে যাওয়ায় পানি উপচে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের রায়শ্রী, দক্ষিণবালি ও হাতিগড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেচ প্রকল্পের প্রধান খালে পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ আছে। কিন্তু শাখা খালের হাতিগড় এলাকায় শেষ দিকে দক্ষিণবালি থেকে হাতিগড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারে পানি পৌঁছায়নি। খালে ঘাস জন্মেছে। হাতিগড় এলাকায় এখনো অনেক জমি খালি পড়ে আছে। এর মধ্যে কিছু জমিতে আমন ধান কেটে নেওয়ার পর যে নাড়া ছিল, তাই খাড়া হয়ে আছে। কিছু জমিতে ঘাস গজিয়ে সবুজ হয়ে আছে। চারা রোপণ করা জমির পানি শুকিয়ে গেছে। খেতের তলানিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে রায়শ্রী এলাকার শাখা সেচ খালের দুই পাড়ের মাটি ক্ষয়ে অনেকটা নিচু হয়ে গেছে। কিছু জায়গায় বাঁধ নিচু হওয়ায় কৃষকেরা নিজেদের উদ্যোগে বাঁধের ওপর আলের মতো করে উচ্চতা সৃষ্টি করেছেন, যাতে পানি বাঁধ উপচে না যেতে পারে।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনু নদ সেচ প্রকল্পের পানির ওপর ভরসা করে এসব এলাকায় বোরো ধান চাষ করেন কৃষকেরা। কিন্তু দুই-তিন বছর ধরে খালে সংস্কার না হওয়ায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শাখাখালের বাঁধ যেখানে নিচু হয়ে গেছে, সেখানে পানি বাঁধ উপচে বেরিয়ে যায়। কোনো কোনো স্থানে ইঁদুর গর্ত করেছে। সেই গর্ত চুইয়ে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার খাল সংস্কার না করায় খাল ঘাসে ভরে থাকে। সেচ প্রকল্পের পানি ছাড়া হলেও পানি সব শাখা খালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে পারে না। একাটুনা ইউনিয়নের হাতিগড় এলাকায় এই সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এ এলাকায় এখনো অনেক কৃষক পানিসংকটে তাঁদের জমিতে হাল চাষ দিতে পারেননি। যাঁরা খেত করেছেন, তাঁদের অনেক খেতও এখন পানিসংকটে পড়েছে। এদিকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে চারা রোপণ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পানিসংকটে এখনো তা করা সম্ভব হচ্ছে না।
সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ চেয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় কৃষক টি এম আলমগীর হোসেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে একটি আবেদন করেন। আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমরার ধান রুয়া (রোপণ) জানুয়ারিতে শেষ অই (হয়ে) যাওয়ার কথা। কিন্তু পানির কারণে অখনো (এখনো) অনেক জমিতে রুইতাম (রোপণ) পারছি না। আর সপ্তাহ দিন রুয়া যাইব। এরপর আর রুইয়া লাভ নাই। যেন (যে জমিতে) ধান পাইতাম (পেতাম) ২০ মণ, অনো (এ ক্ষেত্রে) পাইমু (পাব) ১২ মণ।’
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের নির্ধারিত বীজচাষি রকিব চৌধুরী বলেন, ‘শুধু এই এলাকাই না, পানির অভাবে অনেক জায়গায় হালই চলছে না। শাখা সেচ খালের শেষের দিকে সমস্যা বেশি। শ্যামরার বাজার, একাটুনা-রায়পুর এলাকাতেও একই রকম সমস্যা। সংস্কার না করায় খাল ঘাসে ভরে আছে। অনেক জায়গায় বাঁধ জমির সমান হয়ে গেছে। আমার প্রায় ৩০ একর জমি। পানিসংকটে এখনো পাঁচ-ছয় একরে চাষ বাকি।’
এ বিষয়ে পাউবো মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘কিছু জায়গায় এ সমস্যা আছে। বাঁধের কিছু নিচু জায়গা ঠিক করে দিয়েছি। প্রকল্পে ১০৫ কিলোমিটার বাঁধ আছে। বছরে বরাদ্দ মেলে ৫০-৬০ লাখ টাকা। এত অল্প বরাদ্দ দিয়ে সবকিছু করা সম্ভব হয় না। মনু পুনর্বাসন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্যানেল, বাঁধ সবকিছু ঠিক করা হবে।’