ই-নথিতে সরকারি কাজে গতি
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল খালেক। মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট তালিকায় নিজের নামের সংশোধন ও ডাকঘরের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেন। তাঁর এই আবেদনের পুরো কাজ হয় সরকারি কর্মকর্তাদের অনলাইন ব্যবস্থাপনা ই-নথির মাধ্যমে, যেখানে ছিল না কোনো কাগজের ব্যবহার।
সরকারি কাজের গতি বাড়াতে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় ই-নথি কার্যক্রম। সরকারি কাজের সেবাকে ডিজিটাল করতেই ই-নথির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ই-নথিকে বলা হচ্ছে কাগজহীন সরকারি দপ্তর। এটি দিয়ে সরকারি কাজের গতি ও স্বচ্ছতা বেড়েছে। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে দাপ্তরিক কাজে কমে আসছে দুর্নীতি ও সময়ক্ষেপণের সুযোগ। নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আবেদন, জমি–জমা, কৃষিতথ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাজকর্মসহ সব ক্ষেত্রে দ্রুত সেবা দেওয়া হচ্ছে ই-নথি কার্যক্রমে।
অন্তত আটজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি কার্যালয়গুলোতে কাজ হয় পুরোনো ফাইলিং পদ্ধতিতে, যা ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে। এর বিপরীতে ই-নথির মাধ্যমে কাজ অনেক পরিবেশবান্ধব এবং আর্থিকভাবে কম খরচে হয়। আগে সাধারণত সরকারি কার্যালয়, দপ্তর বা বিভাগের কার্যক্রম কম্পিউটারে টাইপ করে বা হাতে লিখে পরিচালনা করা হতো। পরে তা সংরক্ষণ করা হতো। এতে সরকারি দপ্তরে ফাইলের স্তূপ জমত, নাগরিকেরা হয়রানির শিকার হতেন। একটি সাধারণ অফিস আদেশ হতে কখনো কখনো তিন থেকে চারটি টেবিল ঘুরতে হতো। ফলে কমে যেত কাজের গতি। এই ধীরগতির কাজকে দ্রুত করতে লাগত ঘুষ বা স্পিড মানি। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা ঘরে বসে আবেদন করতে পারেন। একই সঙ্গে ঘরে বসেই নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যান। ফলে দপ্তরে এসে আগের মতো আর হয়রানির শিকার হতে হয় না তাঁদের।
ই-নথি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে সরকারের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্তৃপক্ষ। এটুআই সূত্র জানিয়েছে, ই-নথির মাধ্যমে সরকারি কাজে জবাবদিহি বাড়ছে। কাগজমুক্ত ই-নথি ব্যবস্থাপনা সময় বাঁচাচ্ছে এবং জনগণ ও সরকারকে আরও ঘনিষ্ঠ করছে। ২০১৬ সালে ই-নথি কার্যক্রম শুরু হয়। তবে গত বছরের ৩০ জানুয়ারিতে ই-নথি কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এই সময়ের মধ্যে দেশের ৭ হাজার ৯০০টি সরকারিকার্যালয় এই প্ল্যাটফর্মের অধীনে এসেছে। দপ্তরগুলোতে পত্র জারি, অফিস আদেশ এবং দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজ চলছে ই-নথির মাধ্যমে। ই-নথি ওয়েবসাইট ও মুঠোফোনের অ্যাপ ব্যবহার করে এ পর্যন্ত ৩২ লাখ ৭৩ হাজার ৯১০টি সরকারি পত্র জারি হয়েছে। আর নথি নিষ্পত্তি হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮০টি।
>কাগজমুক্ত ই-নথি ব্যবস্থাপনা সরকারি কাজে সময় বাঁচাচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা ই-নথি অ্যাপ চালাচ্ছেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ই-নথি অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। জনগণকে দুর্বার গতিতে সেবা দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুত ও স্মার্ট হতে হবে। আর দ্রুত কাজ করার ব্যবস্থা ই-নথিতে রাখা হয়েছে।
জিয়াউল আলম আরও জানান, ই-নথির বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কাজ হচ্ছে বলে এই সেবার স্বচ্ছতা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা যায়। সময়ের মধ্যে কাজ নিষ্পন্ন করতে এই সেবা নিজেই সতর্কবার্তা দিচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে।
এটুআই সূত্রে জানা গেছে, সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও দুটি বিভাগের অধীনস্থ কার্যালয়গুলোতে ই-নথির মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজের সূত্রপাত হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের ৯০ শতাংশের দাপ্তরিক কাজ চলছে ই-নথির মাধ্যমে। সরকারি বেশ কয়েকটি দপ্তরের প্রায় ৭০ থেকে ৯৫ ভাগ কাজ করা হচ্ছে ই-নথির মাধ্যমে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে, কম খরচে ও হয়রানি ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে।
এটুআইয়ের ই-নথি ব্যবস্থাপনার প্রকল্প পরিচালক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সরকারি সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন কর্মকর্তারা। বিদেশে বা ভ্রমণে থাকা অবস্থাতেও দ্রুততার সঙ্গে কাজ হয়ে যায়। কাজগুলো ঝুলে থাকার সুযোগ নেই। ই-নথি নানাভাবে সরকারের কাজের গতি বাড়াচ্ছে।
ই-নথির জাতীয় উপদেষ্টা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব নিলুফা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে জানান, সরকারের লক্ষ্য, ই-নথি ব্যবহারে বাধ্যতামূলক পয়েন্ট পাওয়ার জন্য প্রত্যেক সরকারি দপ্তরকে কিছু না কিছু কাজ করতেই হয়। এতে সবার মধ্যে ইতিবাচক সাড়া এসেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব সরকারি দপ্তরকে ই-নথি ব্যবস্থাপনায় এনে কাগজের ব্যবহার একদম কমিয়ে আনাটাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।