ভোটের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ, ইসি নির্বিকার
আর পাঁচ দিন পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ। প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন প্রার্থীরা। ঘটছে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তত বাড়ছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বিকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইসির হাতে ক্ষমতা থাকলেও প্রয়োগ করছে না। ফলে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। ইসির এই নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও। তিনি বলেছেন, এই নির্বাচনে ইসির যেভাবে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন, সেভাবে করছে না। ইসির ভেতরেই কোনো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সবার জন্য সমান সুযোগ) নেই।
শুরু থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে বিএনপি। তারা বলছে, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে পক্ষপাতদুষ্ট, কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংশয় না থাকলেও সমান সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ তাদেরও আছে। তবে দলটি মনে করে, নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রয়েছে।
গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় থেকে শুরু হয় আচরণবিধি লঙ্ঘন। এই লঙ্ঘন ঠেকাতে ইসি নিজ উদ্যোগে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ইসি সূত্র জানায়, দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বড় কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। চারজনকে জরিমানা করা হয়েছে মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে।
২১ জানুয়ারি মিরপুরে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। পুলিশ তদন্ত করে বলেছে, সেখানে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের প্রতিবেদন ইসিতে দেওয়া হয়েছে। তবে গতকাল রোববার পর্যন্ত ইসির কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এমনকি ইসি এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনাও করছে না। এর মধ্যে গতকাল পুরান ঢাকায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের হামলার পর সংঘর্ষ বেধে যায়।
এর বাইরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মাইকে চলছে উচ্চশব্দে প্রচারণা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার মেয়র প্রার্থী যেখানে প্রচারে যাচ্ছেন, সেখানেই মিছিল, যানজট ও চলাচলে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।
>হামলা, সংঘর্ষ বাড়ছে
আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ১০৪টি
ইসির কোনো পদক্ষেপ নেই
এসব বিষয়ে ইসির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তিনটি কমিশন সভা হয়েছে। এর কোনোটিতেই আচরণবিধি, অনিয়ম বা প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো কমিশন সভার আলোচ্যসূচিতেও এসব ছিল না। ২৮ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের যে সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতেও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে কোনো বিষয় আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়নি। তিনি বলেন, ১৬ জানুয়ারি একটি চিঠি দিয়ে তিনি ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে তথ্য জানাতে বলেছিলেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা ২০ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই নির্দেশও উপেক্ষিত হয়েছে।
তবে মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচজন কমিশনারকে নিয়ে কমিশন। তাঁদের কোনো বিষয়ে দ্বিমত হয়, আবার আলোচনার মাধ্যমে একমতও হন। কমিশনার তথ্য চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা তা দিতে বাধ্য। তবে তাঁরা কমিশনকে তথ্য জানাবেন। একজন কমিশনারের কাছে তথ্য দিতে বাধ্য নন। দিলে পাঁচজনের কাছে দিতে হবে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে মো. আলমগীর বলেন, কোনো প্রার্থী যাত্রা করলে তাঁর পেছনে কেউ মিছিল বা আনন্দ উল্লাস করলে, এটা কে ফেরাবে। মানুষের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিতে এটা ঠেকানো কঠিন। তাঁরা সংশ্লিষ্টদের সাবধান করে দেন। তবে আইনকে সময়োপযোগী করার প্রয়োজন হতে পারে।
এখন পর্যন্ত দুই সিটির চারটি ওয়ার্ডে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরে অন্তত ১৫টি ও দক্ষিণে অন্তত ২৩টি ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থীদের পোস্টার ছেঁড়া ও প্রচারণা কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জনমনে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়াতে বিএনপির প্রার্থীদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। ইসি সবার জন্য সমান সুযোগ অতীতেও নিশ্চিত করেনি, এখনো করছে না। একজন কমিশনারই এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা ইসির উদ্দেশ্য নয়, ইভিএমের মাধ্যমে জনগণের অধিকার লুট করাই মূল লক্ষ্য।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, মন্ত্রী–সাংসদেরা নির্বাচনী কার্যক্রম এবং প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের উপদেষ্টা পরিষদের দুই সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমুকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। তাঁরা দুজনই সাংসদ। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সিইসিও বলেছিলেন, সাংসদেরা নির্বাচনের সমন্বয়ক থাকতে পারেন না।
৯ জানুয়ারি সিইসিকে চিঠি দিয়ে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে মন্ত্রী ও সাংসদদের নির্বাচনী কার্যক্রম এবং প্রচারে অংশ নেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন মাহবুব তালুকদার। এরপর ১৩ জানুয়ারি আরেকটি চিঠি দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রচার ও নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে মন্ত্রী-সাংসদদের বিরত রাখতে পরিপত্র জারির অনুরোধ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে ইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, দু–একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে। সাংসদ ও মন্ত্রী হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই আচরণবিধি মেনে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন না। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের মহাসচিবসহ সব বড় নেতা প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। আচরণবিধির কারণে আওয়ামী লীগই বরং সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক পদে থেকে চমক সৃষ্টির জন্য বক্তব্য দেবেন, এটা ঠিক নয়। দায়িত্বে থেকে এসব না বলে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। এ ছাড়া ইসিকে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও দেওয়া আছে। ইসিকে অবশ্য তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার এবং সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। ক্রমে নির্বাচন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলছেন, এসব নিয়ে ইসিতে আলোচনা হচ্ছে না। এভাবে ইসি চলতে পারে না। আবার অনেক দিন থেকেই নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সমন্বয় নেই। নির্বাচন পরিচালনার দুর্বলতা, সমস্যা, আন্তরিকতা কতটুকু আছে—এসব বিষয় প্রকাশ্যে আসছে। নির্বাচনেও এসবের প্রভাব পড়বে।