ক্যাসিনো কী, চেনেন না হুইপ সামশুলের পিএ
ক্যাসিনো কী, তা চেনেন না বলে দাবি করেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) নূর উর রশীদ চৌধুরী ওরফে এজাজ চৌধুরী। কোনো অবৈধ সম্পদ নেই বলেও দাবি তাঁর। একই সঙ্গে হুইপের সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দুদকের প্রধান কার্যালয় এজাজ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল। ক্যাসিনো-কাণ্ডে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে এজাজ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, কেউ দুদকে অভিযোগ করেছে, তাই দুদক ডেকেছে।
তবে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত সাংবাদিকদের বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানতে তাঁদের তলব করা হয়।
এর আগে ১৪ জানুয়ারি এজাজ চৌধুরীকে তলবি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশে বলা হয়, ঠিকাদার জি কে শামীমসহ অন্যান্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জন করে বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের জন্য বক্তব্য রেকর্ড করে পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এজাজ চৌধুরী দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে হুইপের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। হুইপের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাও নন তিনি। তবে তিনি পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ওই আসনের সাংসদ।
চট্টগ্রামের ক্লাবগুলোয় পরিচালিত জুয়ার আসর থেকে নিয়মিত টাকা নিতেন বলে যে অভিযোগ আছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এজাজ চৌধুরী বলেন, ‘জুয়া-ক্যাসিনো কী, তা আমি জানি না, চিনি না।’
দুদক সূত্র জানায়, সরকারদলীয় হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সাংসদ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা আর তদবির-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে। তিনি চট্টগ্রামের ক্লাবগুলোয় চলা জুয়ার আসর থেকে প্রতিদিন বড় অঙ্কের অর্থ পেতেন বলেও অভিযোগ আছে দুদকের হাতে।
দুদক সূত্র জানায়, এজাজের অবৈধ সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে তাঁর বাবা আবদুল মালেক, বড় ভাই সুলতান উর রশীদ চৌধুরী এবং স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের সম্পদেরও খোঁজ নিচ্ছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাঁদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে দুদক। এ ছাড়া ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে তাঁর সম্পদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের আবাহনী ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাব। ক্লাবটির মহাসচিব হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। র্যাবের অভিযানের পরপরই চট্টগ্রামের ক্লাবে জুয়ার আসর পরিচালনার সঙ্গে হুইপের নামও উঠে আসে। র্যাবের অভিযান নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।
হুইপ বলেন, ‘চট্টগ্রামে শতদল, ফ্রেন্ডস, আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১২টি ক্লাব আছে। ক্লাবগুলো প্রিমিয়ার লিগে খেলে। ওদের তো ধ্বংস করা যাবে না। ওদের খেলাধুলা বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের পাঁচ টাকা বেতন দেয়? ওরা কীভাবে খেলে, টাকা কোন জায়গা থেকে আসে, সরকার কি ওদের টাকা দেয়? দেয় না। এই ক্লাবগুলো তো পরিচালনা করতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সামশুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবে বসে তাস খেলেন। এটা কি জুয়া হলো? জুয়া হলে তো আপনারা প্রেসক্লাবেও বসতে পারবেন না। তাস খেললেও জুয়া। তাস ধরলেই জুয়া। আর অভিযানে ক্যাসিনো বের করতে পারলে তাদের বাহবা দেওয়া যেত।’ সাংসদ ঘুষের ব্যবসাও বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশাসনকে বলব, ঘুষের ব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁদের ধরেন। ঘুষ যাঁরা নেন, তাঁদের ধরেন। যাঁরা দেন, তাঁদেরও ধরেন।’
সামশুল হক চৌধুরীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে ২৩ অক্টোবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অন্য ২২ জনসহ সামশুল হক চৌধুরীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।
১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে প্রথম দিনই রাজধানীর ইয়াংমেনস ফকিরাপুল ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কার করা হয়) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান) ও তারেকুজ্জামান রাজীব।
গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ ওঠে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের অপকর্মে সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি তাঁদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। পরে আরও দুজনকে দলে যুক্ত করা হয়। দলের অন্য সদস্যরা হলেন উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।
অনুসন্ধান দলের সদস্যরা গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম যাচাই-বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেন। সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। পাশাপাশি র্যাব ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানেরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেন। সেসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এ পর্যন্ত ২০টি মামলা করে দুদক দল। এসব মামলা হয়েছে ঠিকাদার জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও তাঁর ভাই রূপন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, এনআরবি ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার সুমা এবং গণপূর্তের সিনিয়র সহকারী শাখাপ্রধান মুমিতুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে।