'ভুয়া পরোয়ানার' চক্করে ৬৮ দিন
>উচ্চ আদালতের আদেশের পর ৬ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার আওলাদ হোসেন।
একের পর এক মামলা দেখিয়ে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগার এবং এক আদালত থেকে অন্য আদালতে হাজির করা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার মো. আওলাদ হোসেন অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন। পৃথক পাঁচটি জেলার পাঁচ মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ‘পরোয়ানা’ জারির সত্যতা পাওয়া যায়নি। আটকের ৬৮ দিন পর হাইকোর্টের আদেশে ৬ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছেন তিনি।
‘ভুয়া পরোয়ানার চক্করে আওলাদ, হাইকোর্টে স্ত্রী’ শিরোনামে গত ৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর আগে আওলাদকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতে তাঁকে হাইকোর্টে হাজির করতে নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন তাঁর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তি পান আওলাদ।
হাইকোর্ট আওলাদের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া ওয়ারেন্ট’ তৈরির ঘটনা তদন্ত করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক নির্দেশ দিয়েছেন।
হাইকোর্ট যখন আদেশ দেন, তখন আওলাদ শেরপুর কারাগারে ছিলেন। শেরপুরের মামলায় আওলাদের বিরুদ্ধে জারি করা ওয়ারেন্ট যাচাই সাপেক্ষে ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হলে তাঁকে মুক্তি দিতে শেরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন। আর পরোয়ানা সঠিক হলে আইন অনুসারে আওলাদের জামিন আবেদন বিবেচনা করতে বলা হয়। একই সঙ্গে জামিনে থাকলে আওলাদ নিজে ১৫ জানুয়ারি আদালতে হাজির হবেন, আর কারাগারে থাকলে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে ওই দিন আদালতে হাজির করবে বলে হাইকোর্টের আদেশে উল্লেখ করা হয়।
আওলাদ হোসেন ঢাকার আশুলিয়া থানার টাকসুর গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বয়স ৫৫ বছর। তিনি ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন। সাভারে গত শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জমি নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ রয়েছে। দেশের বাইরে থাকার সময় তাঁর মায়ের সম্পত্তি জাল–জালিয়াতি করে দখল করে নেয় একটি চক্র। এ নিয়ে থানায় জিডি ও মামলা করেছিলেন। এর জেরেই এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
‘পরোয়ানার’ চক্করে ৬৮ দিন
নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক মামলায় গত বছরের ৩০ অক্টোবর আওলাদকে আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন তাঁকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হলে জামিন চান তিনি। ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আশুলিয়া) জামিন নামঞ্জুর করে মামলার নথিপত্র কক্সবাজারের আদালতে পাঠাতে আদেশ দেন।
নথিপত্র কক্সবাজারের আদালতে পৌঁছার পর আওলাদের জামিন চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ নভেম্বর কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ আদেশ দেন। এতে বলা হয়, ওই মামলায় আওলাদ নামে কোনো আসামি নেই। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি ট্রাইব্যুনাল থেকে ইস্যু হয়নি। ওই পরোয়ানা নকল। তাঁকে (আওলাদ) মুক্তি দেওয়া হোক।
কক্সবাজারের আদালতের দেওয়া আদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসে। কারাগার থেকে আওলাদের মুক্তির আগেই নারী ও নিশু নির্যাতনের অভিযোগে রাজশাহীর এক মামলায় (১৩৭/২০১৬) তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি পরোয়ানা পৌঁছায়।
আওলাদকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহীতে। সেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তাঁকে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গত ২৪ নভেম্বর
আদেশ দেন। এতে বলা হয়, ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ট্রাইব্যুনালের নয়। তাঁকে অব্যাহতি ও মুক্তি দেওয়া হোক।
ট্রাইব্যুনালের ওই আদেশ রাজশাহীর কারাগারে পৌঁছায়। তবে মুক্তির আগেই বাগেরহাটের একটি মামলায় (সিআর ২৪৫/১৭) আওলাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা রাজশাহীর কারাগারে পৌঁছায়। পরে আওলাদকে বাগেরহাটে নিয়ে যাওয়া হয়। বাগেরহাটের আদালতে হাজির করার পর তিনি জামিন চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১ ডিসেম্বর বাগেরহাটের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেন। এতে বলা হয়, হাজিরা পরোয়ানাও এই আদালত ইস্যু করেনি। বিচারকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া স্মারক নম্বর ব্যবহার করে পরোয়ানাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।
এ আদেশ বাগেরহাটের কারাগারে পৌঁছানো হয়। তবে মুক্তির আগেই শেরপুরের এক মামলায় (সিআর ১৫৯/১৮) আওলাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা বাগেরহাট জেলা কারাগারে পৌঁছায়। পরে আওলাদকে গত ৫ ডিসেম্বর শেরপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ অবস্থায় গত ৮ ডিসেম্বর আওলাদের স্ত্রী রিট করেন, যার শুনানি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ কয়েক দফা নির্দেশ দেন।
অন্য কোনো মামলায় আওলাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা বা হাজিরা পরোয়ানা থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দিতে আইজি প্রিজন্স ও শেরপুর কারাগারের সুপারিনটেনডেন্টকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের আদেশের পর
নথিপত্রে দেখা যায়, হাইকোর্টের আদেশের পর আওলাদকে ১ জানুয়ারি শেরপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। সেদিন ওই মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিতে আবেদন জানান আওলাদের আইনজীবী।
ওই মামলায় আওলাদের নাম নেই উল্লেখ করে শেরপুরের আদালতের আদেশে বলা হয়, সার্বিক পর্যালোচনায় উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট) নির্দেশনা অনুসারে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকলে তাঁকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে শেরপুরের জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ১৫ জানুয়ারি তাঁকে (আওলাদ) হাইকোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
শেরপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে ঢাকার একটি মামলায় (মেট্রো দায়রা-৯৬৭৫/১৭) আওলাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা শেরপুর কারাগারে পৌঁছায় বলে জানান আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জানুয়ারি তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, ওই মামলায় আওলাদ আসামি নন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আদালতে চিঠি পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জানুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (দ্বিতীয় আদালত) জানান, ওই মামলা সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারাধীন নেই। পরোয়ানাটি ওই আদালত থেকে ইস্যু করা হয়নি এবং পরোয়ানায় কথিত স্বাক্ষরও বিচারকের নয়। এ অবস্থায় হাইকোর্টের রিটের নির্দেশনা অনুসারে কোনো মামলা না থাকায় ৬ জানুয়ারি আওলাদ হোসেনকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, স্পষ্টত হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারব্যবস্থার নামে এমন অপব্যবহার আশঙ্কাজনক। এই অপব্যবহার রোধে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে ওই ঘটনার দ্রুত ও সুচারু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাতে এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীকে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।