২ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না
দেশের প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের, অর্থাৎ ২ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আর সুষম খাবার কেনার সামর্থ্য নেই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের। এ কারণে তারা ভাত, রুটি ও কম পুষ্টিকর খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের খাদ্যঘাটতি পূরণ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। গত বুধবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে পুষ্টিসম্মত খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং মানুষের তা কেনার সামর্থ্য কতটুকু আছে, তা নিয়ে বিশদ তথ্য ও বিশ্লেষণ রয়েছে।
প্রতিবেদনের শুরুতে পুষ্টির সমস্যা কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, অপুষ্টির কারণে শিশুদের যে খর্বাকৃতির
সমস্যা ছিল, তা গত ২১ বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৯৯৭ সালে যেখানে দেশে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, ২০১৮ সালে তা কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা এখনো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি। একটি দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার দিক থেকে এই সমস্যা একটি বড় বাধা।
অন্যদিকে দেশে নারীদের পুষ্টির পরিস্থিতি এখনো বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব অধ্যাপক শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার বসে নেই। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়াসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। তারা যদি ভালো ও পুষ্টিকর খাবার বলতে পাউরুটি, বার্গার ও মিষ্টিকে
বোঝে, তাহলে হিতে বিপরীত হবে। পুষ্টি কমার বদলে স্থূলতা বাড়বে।
দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া জরুরি বলে মত দেন বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির এ দেশীয় উপপরিচালক আলফা বাহ।
>খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা এখনো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেশি
১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অতিদরিদ্র এবং তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সুষম পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেল–জাতীয় খাদ্য। সেগুলো কোনো একটি পরিবারকে কিনে খেতে গেলে তাকে দিনে ১৭৪ টাকা খরচ করতে হবে। কিন্তু খাওয়ার পেছনে ওই অর্থ খরচের সামর্থ্য নেই। তারা প্রতিদিন খাদ্যশক্তি পায় ভাত, আলু, রুটি ও সবজি থেকে। যার পেছনে তারা দিনে ৮০ টাকার বেশি খরচ করতে পারে না।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির অন্য দিকও উঠে এসেছে। দেশে বছরে ৮ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়। দেশে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। ২০০৪ সালে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৯ শতাংশ স্থূলকায় ছিল। এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বেড়ে ২৪ শতাংশে ছাড়িয়েছে। এসব জনগোষ্ঠীর আর্থিক সামর্থ্য বেড়ে যাওয়ায় তারা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার খাচ্ছেন। এতে তাঁদের পুষ্টি বাবদ খরচ ৪০ শতাংশ বাড়ছে, কিন্তু পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
অন্যদিকে আর্থিকভাবে সামর্থ্য না থাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রয়োজনীয় অনুপুষ্টিকণার ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে, মেয়ে ও বৃদ্ধদের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। কম বয়সী মেয়েরা পুষ্টি সমস্যায় ভুগছে। এর সঙ্গে তারা বাল্যবিবাহ, গর্ভধারণের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
প্রতিবেদনে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির জন্য চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়। বলা হয়, দেশের মানুষের আয় যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী ১০ বছরে মাংস, ফল ও দুধের চাহিদা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু এই সময়ে দেশে সবজি ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়তে পারে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে প্রতিবছর ৩ হাজার ৪৪২ কোটি টাকার সমপরিমাণ সবজি নষ্ট হয়। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খাবার নষ্ট হওয়া বন্ধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুষ্টি সমিতির সভাপতি ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক নয়। দেশের মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিয়ে জ্ঞানের অভাব এর জন্য মূলত দায়ী। মানুষ বেশি দাম দিয়ে কম পুষ্টিকর খাবার কিনছে। পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে মানুষের ধারণা বাড়ানোর জন্য সরকারের আরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার।