বঙ্গোপসাগরে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, দিনে ৭৩ হাজার টন
পদ্মা থেকে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। কোমল পানীয়র বোতল থেকে শুরু করে থালা, কসমেটিকসের মোড়ক ও নিত্য ব্যবহার্য থালা ও জগ সবই ছিল ওই তালিকায়। ব্যবহার করার পর তা বিভিন্ন জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে।
পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে করা এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘উৎস থেকে সাগরে’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অংশ নেন। গবেষক দলের সদস্যরা পদ্মা থেকে বঙ্গোপসাগরের ওই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে মোট ৫৬ হাজার প্লাস্টিক পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওই দলটি প্রায় দুই মাস ধরে তাদের গবেষণা বিষয়ক অভিযান চালায়। সংস্থাটির ফেলো জেনা জ্যামবেক ও হিথার কোল্ডেওয়ের যৌথ নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওই দলটি পদ্মা নদীর বঙ্গোপসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৫৭৫ কিলোমিটার অংশে জরিপ করে। পদ্মা নদীর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশে পরিচালিত এই অভিযানটি দ্বিতীয় পর্যায় খুব দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে এই নদীতে বর্ষা-পরবর্তী সময়ে প্লাস্টিক দূষণের কার্যক্রমগুলোর সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যগুলো শনাক্ত করা হবে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফেলো ও গবেষক দলের উপনেতা হিথার কোল্ডেওয়ে বলেন, ‘সমুদ্রে প্লাস্টিকদূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। প্রতিবছর ৯০ লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক নদীতে গিয়ে পড়ে। এরপর ভেসে ভেসে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। আমাদের এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো জনগণ এবং প্লাস্টিক কীভাবে পদ্মা নদী এবং সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত, তা বোঝা এবং আমাদের তথ্য ব্যবহার করে সচেতনতা তৈরি এবং এর সমাধানের পথ বের করা।’
দিনে ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে পড়ে গত বছরের জুনে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি থেকে ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম। এই বর্জ্যের উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে এগুলো সাগরে যায়।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডিও) করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জলে-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে তিন হাজার টন করে যোগ হচ্ছে। সংস্থাটি দেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, দেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওই গবেষক দল অভিযান চলাকালীন নদী এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বর্ষা-পরবর্তী সময়ে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা পরিমাপ করবে। এ ছাড়া এ সময়ে তাঁরা কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবেন এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু কর্মশালা পরিচালনা করবেন।
ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (ডব্লিউআইআই), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়াইল্ড টিম এবং ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় অভিযানটি পরিচালিত হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হলো প্লাস্টিকের বর্জ্য কীভাবে উৎস থেকে সমুদ্রে যায়, তা লিপিবদ্ধ করা এবং প্লাস্টিকের প্রবাহ ও গঠন সম্পর্কে যে জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ করা। ভারতে টাটা ট্রাস্টও এই উদ্যোগকে সহায়তায় করছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের গবেষক বুশরা নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, মূলত স্বল্প মূল্যের কারণে এসব পণ্যের চাহিদা বেশি। এ ছাড়া এটি সহজলভ্য এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু এগুলো ব্যবহারের পর যখন বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়, তখন তা পরিবেশ ও সামগ্রিকভাবে মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। তাই প্লাস্টিকের সামগ্রী যাতে সরাসরি মাটি ও পানিতে ফেলা না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। তবে জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে।
উৎপাদকদের বর্জ্যের দায়িত্ব নিতে হবে
গবেষক দলটি প্রাথমিক পর্যায়ে প্লাস্টিক সম্পর্কিত ধারণা এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে ২৫০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। মেরিন ডেব্রিস ট্রাকার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোর ধরন চিহ্নিত করে। তারা স্থল ও পানিতে ৩ হাজার কাঠের পচনশীল ‘ড্রিফট কার্ড’ এবং ১০টি ‘বোতল ট্যাগ’ ব্যবহার করে প্লাস্টিক বর্জ্যের গতিবিধি লক্ষ করে।
ইউএনইপির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিদিন তিন কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ৮০ লাখ টন প্রধান ১০টি নদী অববাহিকা দিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। এই ১০ নদীর আটটিরই উৎসস্থল চীন। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দূষণের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও আছে। চলতি বছর বিশ্ব পরিযায়ী দিবসের মূল স্লোগানও ছিল, ‘প্লাস্টিকের হাত থেকে পাখিদের বাঁচাও’।
বাংলাদেশে এককভাবে দিনে তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মাত্র কিছু অংশ নদী দিয়ে সাগরে যায়। বাকি বর্জ্য এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ থেকে আসা বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি অংশ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী এবং ভূভাগকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক কারণেই দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। এটা শুধু এককভাবে বাংলাদেশের সমস্যা না। বিশ্বজুড়ে এটি পরিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে। তাই আমরা এসব পণ্যের উৎপাদকদেরই এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে রাজি করানোর চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিকভাবেও এটি একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠছে। বাংলাদেশ সেই আন্দোলনেও আছে।