৯ বছরে ভারতের অর্থায়ন সাড়ে ৭%
সংযুক্তির জন্য বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি সই করেছিল ভারত। এরপর আরও তিন দফায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ৭০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় ১৪ কোটি ডলার ভারত মঞ্জুরি হিসেবে দিয়েছে। সব মিলিয়ে ভারত এ পর্যন্ত ৭৮৬ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করলেও গত ৯ বছরে দিয়েছে মাত্র ৫৯ কোটি ডলার, শতকরা হিসেবে যা সাড়ে ৭ শতাংশের মতো।
ভারত এ বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের সঙ্গে সর্বশেষ ৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করেছে। মূলত ভারত থেকে প্রতিরক্ষা খাতে কেনাকাটার জন্য চুক্তিটি করেছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যথেষ্ট ধীরগতির। ২০১০ সালের আগস্টে প্রথম চুক্তিটি সই হয়েছিল প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগেই। তাই প্রকল্প চূড়ান্ত করা আর ভারত থেকে কেনাকাটার শর্ত শিথিল করা—এ দুটি বিষয় সুরাহা করতে দেরি হয়েছিল। তা ছাড়া প্রকল্প ছাড়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সরাসরি ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে যাওয়ায় অতিরিক্ত সময় লেগেছিল। অবশ্য ভারত থেকে কেনাকাটার হার শেষ পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় চুক্তির প্রকল্পগুলো চুক্তি সইয়ের আগে ঠিক করা হলেও দুই দেশের নানান প্রক্রিয়াগত জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।
- মোট দেওয়ার কথা ৭৮৬ কোটি ডলার।
- এখন পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৫৯ কোটি ডলার।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এ মাসের ২৫ থেকে ২৮ তারিখে দিল্লিতে ঋণচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা পর্যালোচনা সভায় বসছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কীভাবে দ্রুত করা যায়, তা নিয়ে কথা বলবেন তাঁরা।
দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র সম্প্রতি প্রথম আলোকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন চাহিদা অনুযায়ী ভারত সরকার এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ক্রমশ সম্প্রসারিত করছে। এসব ঋণের আওতায় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। ঋণচুক্তি আওতায় থাকা ৪৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৪১ কোটি ১০ লাখ ডলারের ১৪টি প্রকল্প ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ৮২টি কোটি ডলারের ৫টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় আছে কিন্তু কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি, এমন ৯টি প্রকল্পের আর্থিক মূল্য ১৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। দরপত্র পরিকল্পনা বা প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির পর্যায়ে সব মিলিয়ে ১৮টি প্রকল্প আছে, যা ঋণচুক্তির মোট প্রতিশ্রুতির প্রায় ৬৬ শতাংশের সমান। ঠিকাদার নিয়োগের আগ পর্যন্ত ঋণচুক্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি কার্যকর হয় না। এর ফলে ঋণচুক্তির তহবিলের ব্যবহার বিলম্বিত হচ্ছে।
তবে ইআরডি সচিব মনোয়ার আহমেদ গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন আগের চেয়ে গতি পেয়েছে। কারণ, সমস্যাগুলো নিয়ে এখন খুব ঘন ঘন আলোচনায় বসছি। আশা করি, প্রথম দুটির তুলনায় তৃতীয় ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন অনেক দ্রুত হবে।’
এ পর্যন্ত মোট অর্থায়ন
বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তিতে অর্থায়ন করে থাকে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বা এক্সিম ব্যাংক। অবশ্য এর আগে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে এই ঋণের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের আগস্টে পণ্য কেনাকাটা, রেলওয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নদী খনন, সেতু নির্মাণ, বাস, রেলের ইঞ্জিন ও বগি কেনাকাটা এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা সংস্কারের জন্য ৮৬ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি সই হয়। চুক্তির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ১২টি শেষ হয়েছে। গত ৯ বছরে ৫৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার খরচ হয়েছে।
দ্বিতীয় চুক্তিতে ২০০ কোটি ডলারের ১৬টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ প্রকল্পে পরামর্শক/কেনাকাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এই চুক্তির আওতায় দেড় কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
তৃতীয় চুক্তির সাড়ে ৪৫০ কোটি ডলারের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৭টি প্রকল্প ঠিক করা হলেও জুলাই পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েছে ৪টি প্রকল্প। এ পর্যন্ত এসেছে ১২ লাখ ডলার। এ বছরের এপ্রিলে প্রতিরক্ষা খাতে কেনাকাটার জন্য ৫০ কোটি ডলারের শেষ ঋণচুক্তিটি সই হয়। তবে এর আওতায় কী কী কেনাকাটা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এম ফওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের ঋণচুক্তিতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া যত প্রতিশ্রুতি ভারত দিয়েছে, সেই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ নেই। ভারত অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলছে। ভারতীয় ঋণে শুধু ভারতীয় ঠিকাদারদের কাজ দিতে হয়। এতে ভালো প্রতিযোগিতা হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব আছে।
দেরি কমানোর সুপারিশ
জুলাই মাসে ঢাকায় ঋণচুক্তির ১৫তম পর্যালোচনা সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে দরপত্রের প্রক্রিয়া এবং মূল্যায়ণ্যের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিমালা অনুযায়ী বড় প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে মূল্যায়ণ প্রক্রিয়া পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৩ থেকে ১৪ সপ্তাহের সময়সীমার প্রসঙ্গটি এসেছে।
জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন পরামর্শক এবং প্রকৌশলী, ক্রয় ও নির্মাণসংক্রান্ত ঠিকাদারদের বিল পেতে দেরি হওয়াকে প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম সমস্যা বলেছে ভারত। তাই দ্রুত কাজের বিল পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।