২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জাতীয় চার নেতা হত্যা: ৪৪ বছর পরও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান

জেলখানার ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল ৪৪ বছর আগে। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে​ গেছেন খুনিরা। জেলহত্যা মামলা নামে পরিচিত এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিচারের তিনটি ধাপ পার হলেও দণ্ডিত ১১ আসামির সবাই পলাতক আছেন, যাঁদের তিনজন মৃত্যুদণ্ড ও আটজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। তাঁদের মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত।

আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। কেবল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজনের ব্যাপারে তথ্য আছে। তাঁদের মধ্যে কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-নেতারা অনেক কথা বলেন। পরে এ নিয়ে আর তেমন কোনো আলোচনা থাকে না।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং পরে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রায় আংশিক কার্যকর হয়েছে। বাকি আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সাজা কার্যকর করা প্রক্রিয়াধীন। পলাতক যারা বিদেশে আছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। নির্মম এই ঘটনার ঠিক আগে একই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।

জেলখানায় নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের পরদিন ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁর নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করার পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ঘটনার পরদিন মামলা করা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। এরপর থেমে থেমে চলে মামলার কার্যক্রম।

>

দণ্ডিত ১১ আসামির সবাই পলাতক। দুজন ছাড়া বাকি আসামিরা কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত তথ্যও নেই।

ঘটনার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১২ আসামি হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথিপত্র ২০০৮ সালে হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন দণ্ডিত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান। আপিলকারী চার দণ্ডিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন দণ্ডিত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।

অবশ্য সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (‍ল্যান্সার) জেল হত্যায় অব্যাহতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এদিকে জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১১ আসামির কাউকে আজ পর্যন্ত সাজার আওতায় আনা যায়নি। আসামিদের সবার অবস্থান সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

জেলহত্যায় নিহত চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার নেতার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমারও দাবি, আসামিদের দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক৷’