একটির দামে দুটি ড্রিমলাইনার কিনছে বিমান
সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ চতুর্থ ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮ ‘রাজহংস’ উদ্বোধনের পর থেকে আলোচনায় আসে—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে আরও দুটি বোয়িং যুক্ত হচ্ছে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দুটি বোয়িং কেনার আগ্রহ দেখান। পরে জানা যায়, আরও বড় আকৃতির বোয়িংয়ের ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার কিনতে যাচ্ছে বিমান। এর পর মাসখানেক ধরে বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে বিমান দর-কষাকষি করে। বিমান-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার বর্তমান বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে, অর্থাৎ ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কমে কেনা হচ্ছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে নতুন দুটি উড়োজাহাজ বিমান বহরে চলে আসবে।
বিমান বহরে বর্তমানে উড়োজাহাজ রয়েছে ১৬টি। এগুলোর মধ্যে নিজস্ব উড়োজাহাজের সংখ্যা ১০টি। বাকি ৬টি লিজে আনা। নিজস্ব ১০টি উড়োজাহাজের সবই বোয়িং কোম্পানি থেকে কেনা। এর মধ্যে ৪টি ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮,৪টি ৭৭৭-৩০০ ইআর ও ২টি ৭৩৭-৮০০। নতুন দুটি ৭৮৭-৯ উড়োজাহাজ কেনা হলে বিমানের উড়োজাহাজ হবে ১৮টি। এ ছাড়া আগামী বছর কানাডা থেকে কেনা ৩টি ড্যাশ-৮ দেশে আসছে।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, একটি বোয়িং ৭৮৭-৯ উড়োজাহাজের বর্তমান মূল্য ২৯২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২টি ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ উড়োজাহাজের দাম হতো ৪ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। চীনের অন্যতম বেসামরিক বিমান সংস্থা হেইনান এয়ারলাইনস এসব উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি বাতিল করে। এমন প্রেক্ষাপটে বোয়িং কম দামে দুটি ড্রিমলাইনার বিক্রির প্রস্তাব দেয় বিমানকে। এই দুটি ড্রিমলাইনার কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান প্রধানমন্ত্রী। তারপর বোয়িংয়ের সঙ্গে আলোচনার শুরু করে বিমান।
বিমানের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ মডেলের একটি উড়োজাহাজের দাম ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বোয়িংয়ের সঙ্গে দাম ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয় চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে। এই আলোচনায় বোয়িং কোম্পানির পক্ষ থেকে ১৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাম প্রস্তাব করা হয়। তখন বিমানের পক্ষ থেকে দাম বলা হয় ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই দাম জানার পর বোয়িং আরও ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কমিয়ে প্রতিটি ড্রিমলাইনারের জন্য দাম ১৫০ মিলিয়ন প্রস্তাব করে। এর পরও দুপক্ষের মধ্যে দর-কষাকষি চলতে থাকে। সবশেষ ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কমে ড্রিমলাইনার দুটি কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। এর সঙ্গে বাড়তি একটি ইঞ্জিন পাওয়া যাচ্ছে। গত বুধবার বিমানের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সর্বসম্মতিতে ড্রিমলাইনার কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুব শিগগির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দুটি ড্রিমলাইনার কিনতে অর্থায়ন করবে। আর বিমান চলতি মাস থেকে বোয়িং কোম্পানিকে টাকা দেওয়া শুরু করবে।
ওই বৈঠকের পর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোকাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি ড্রিমলাইনার কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন আমরা এগোব।’
দুটি উড়োজাহাজের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে মোকাব্বির হোসেন বলেন, এটি আসলে প্রকাশ করা হয় না। তবে দুটি উড়োজাহাজ এ বছরই চলে আসবে।
ড্রিমলাইনার কেনার অংশ হিসেবে বিমানের একটি দল খুব শিগগির যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বোয়িংয়ের কার্যালয়ে যাবে। জানা গেছে, আগের চারটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের সঙ্গে বোয়িংয়ের কাছ থেকে বাড়তি একটি ইঞ্জিন পেয়েছিল বিমান। নতুন দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারের সঙ্গে বিমানকে আরও একটি বাড়তি ইঞ্জিন দিচ্ছে বোয়িং। ইঞ্জিনগুলো আগের চারটি ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮-এর সঙ্গে যুক্ত জেনারেল মটরসের তৈরি।
বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে কারিগরি বিষয়ে যুক্ত ছিলেন, বিমানের এমন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আগে ধারণা ছিল বোয়িং পুরো উড়োজাহাজ তৈরি করে বিক্রি করে। আসলে তা নয়। বোয়িং কেবল খোলসটি (বডি) নিজেরা তৈরি করে। ইঞ্জিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি অন্য কোম্পানি থেকে কেনা হয়। যেমন বোয়িং তাদের উড়োজাহাজে জেনারেল মটরস বা রোলস রয়েস ইঞ্জিন যুক্ত করে। আমরা যাচাই করে দেখেছি, রোলস রয়েসের চেয়ে জেনারেল মটরসের ইঞ্জিনের মান তুলনামূলক ভালো। তা ছাড়া সিট কভার বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি কোন কোম্পানি থেকে কেনা হবে, রঙের মান, ভেতরের সাজসজ্জা কোন নকশায় করা হবে—তার ওপরও একটি উড়োজাহাজের দাম কমবেশি হয়। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা ক্যাটালগ রাখা আছে বোয়িংয়ের কাছে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনো উড়োজাহাজের দাম কখনোই প্রকাশ করা হয় না। এটি ব্যবসায়িক কারণেই করা হয় না। যেমন এমিরেটস বোয়িংয়ের বড় ক্রেতা। তারা একবারেরই হয়তো ১০০ উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে। বোয়িং সে ক্ষেত্রে বড় এই ক্রেতাকে ধরে রাখতে কম দামে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেবে। কিন্তু ছোট ছোট ক্রেতার ক্ষেত্রে দাম আরেকটু বেশি হবে। তবে দাম থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।
বোয়িং কোম্পানি তিনটি মডেলের ড্রিমলাইনার তৈরি করছে। একটি হলো ৭৮৭-৮। এই মডেলের উড়োজাহাজে ২৭১ জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারেন। এর দৈর্ঘ্য ১৮১ ফুট। একটানা সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে এটি। এরপর রয়েছে ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ মডেলের উড়োজাহাজ। এর দৈর্ঘ্য ২০৬ ফুট। এটি ৩০০ যাত্রী বহন করতে পারে। এটি টানা প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার উড়তে পারে। ড্রিমলাইনারের সবশেষ মডেল হলো ৭৮৭-১০, যা সাড়ে ৩০০ যাত্রী বহন করতে পারে। একটানা এটি উড়তে পারে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার।