কৃষকের রাডার অতনু
জমিতে সেচ দেবেন কৃষক। তার আগে এক ব্যক্তির ফেসবুক পেজে চোখ বুলিয়ে নেন। যাঁদের ফেসবুক নেই তাঁরা মুঠোফোনের খুদে বার্তায় চোখ রাখেন। সেখানেও কোনো বার্তা না পেলে ওই ব্যক্তিকে ফোন দেন। জানতে চান কাল জমিতে সেচ দেবেন কি না। ফসল কাটার আগেও কৃষকের ভরসা ওই ব্যক্তি। বছর চারেক ধরে ওই ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নাম অতনু সরকার (৪২)। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ঈশ্বরীপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
২০০৯ সাল থেকে গোদাগাড়ীতে আছেন তিনি। আর ২০১৫ সালে ঢাকা আবহাওয়া অফিস থেকে ফোনে আবহাওয়ার খবর নেওয়া শুরু করেন। পরে কৃষকদের ফোন করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে, সভা ডেকে সেই তথ্য জানিয়ে দেন। যেমন কাল বৃষ্টি হতে পারে, সেচ দেবেন না। ঝড় ও শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে বার্তা পাঠান, দ্রুত পাকা ধান কেটে নিন। কিছু ফসল আছে, সেচ দেওয়ার পর বৃষ্টি হলে নষ্ট হয়ে যায়। এই চাষিদের আগাম বৃষ্টির খবরটা দেওয়া হয়। যাতে ফসলটা নষ্ট না হয়। ২০১৮ সাল থেকে অতনু ফেসবুকে দেওপাড়া ইউনিয়নের কৃষকদের আবহাওয়ার খবর দিয়ে আসছেন।
অবশ্য ছয় মাস ধরে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস থেকে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে আবহাওয়া বার্তা পাঠানো হচ্ছে। এই বার্তা উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়নভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুধু অতনুই দিচ্ছেন।
১৬ অক্টোবর অতনু ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘কৃষক ভাইদের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস। ১৭ থেকে ২৩ অক্টোবর দেওপাড়া ইউনিয়নে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম। ২৪, ২৫, ২৬ অক্টোবর হালকা বৃষ্টিপাত হতে পারে।’ পরে দেখা যায়, তাঁর পাঠানো বার্তা অনুযায়ী বৃষ্টিপাত হয়েছে।
ইউনিয়নের হাতিবান্দা গ্রামের কৃষক মুক্তার আলী বলেন, তাঁর ৫ বিঘা জমিতে ধান পেকেছিল। অতনু এসে বললেন, তিন দিন পরে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ধান কেটে নিন। তাঁর ধান কেটে নেওয়ার পরের দিন থেকেই বৃষ্টি শুরু হলো।
দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বিশ্বনাথ সরেন বলেন, অক্টোবরে বৃষ্টির আগে অনেকের জমিতে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অতনুর ফেসবুকে বৃষ্টির পূর্বাভাসের খবর জানতে পেরে তাঁরা কেউ আর সেচ দেননি। এখন কেউ বলছেন, এক হাজার টাকা বেঁচে গেল, কেউ বলছেন দেড় হাজার টাকা বেঁচে গেল।
দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বলেন, অতনু সরকার দেওপাড়া ইউনিয়নের কৃষকদের মুঠোফোনে আবহাওয়ার খবর জানিয়ে দেন। তাঁর বার্তা পেয়ে কৃষকেরা সতর্ক হন। কেউ ঝড়ের খবর পেয়ে আগাম পাকা ধান কেটে নেন।
অতনু সরকারের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সমাজ গ্রামে। উদ্ভাবনী ও কৃষি সম্প্রসারণে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পান। ১৯৯৭ সালে শেরপুর অ্যাগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে কৃষিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। বরেন্দ্রভূমিতে মাল্টা, পেয়ারা, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, গ্লাডিওলাস ফুল, আনারস, গ্রীষ্মকালীন তরমুজ, ভেতরে হলুদ রঙের তরমুজ, স্ট্রবেরি, মেওয়া, ড্রাগন, লটকনসহ প্রায় ১০ জাতের নতুন ফসল চাষের প্রচলন করেছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
কীভাবে এই কাজে সম্পৃক্ত হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অতনু শোনালেন বছর পাঁচেক আগের কথা। গোদাগাড়ীর ফুলবাড়ি গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম সরিষাখেতে সেচ দেন। তারপরের দিনই বৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত পানির কারণে তাঁর চার বিঘা জমির সরিষা নষ্ট হয়ে যায়। অতনুর বাবা গৌরাঙ্গ চন্দ্র সরকারও একজন কৃষক। কৃষকের এই ক্ষতি দেখে বিচলিত বোধ করেন তিনি। ভাবেন, এই কৃষককে যদি তিনি বৃষ্টির পূর্বাভাসটা আগেই জানাতে পারতেন, তাহলে তাঁর এই সর্বনাশ হতো না। এরই মধ্যে একটি প্রশিক্ষণে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, আবহাওয়া অফিসের একটি ফোন নম্বর রয়েছে, যেখানে ফোন করলে তাঁরা স্যাটেলাইট দেখে দুই–তিন দিন আগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে পারেন। এরপর থেকে তিনি প্রতিদিন ঢাকায় ফোন করে গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংগ্রহ করতেন এবং সে তথ্য কৃষকদের জানিয়ে দিতেন। শুরুতে তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে, পরে মুঠোফোনে কৃষকদের পূর্বাভাস দিতেন। সম্প্রতি এর সঙ্গে তিনি ফেসবুককে যুক্ত করেছেন।
জানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উপজেলা বা জেলার আবহাওয়ার পূর্বাভাসটা আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে পাই। আর অতনু সরকার নিজের আগ্রহে তাঁর কর্ম এলাকা-ইউনিয়নের পূর্বাভাসটা সংগ্রহ করে কৃষকদের বিলি করেন। নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে উনি কাজটা করেন। এতে কৃষকেরা উপকৃত হন।’