ভোলায় পুলিশের সঙ্গে 'তৌহিদী জনতা'র সংঘর্ষ, নিহত ৪
ভোলার বোরহানউদ্দিনে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক যুবকের বিচারের দাবিতে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ থেকে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত চারজনকে নিজেদের কর্মী–সমর্থক বলে দাবি করেছে তৌহিদী জনতা। সংঘর্ষে ১০ পুলিশ সদস্যসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ঈদগাহ মাঠে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, এক যুবকের হ্যাক হওয়া আইডি থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বক্তব্য ছড়ানোর ঘটনা থেকে এ পরিস্থিতির সূত্রপাত।
নিহত চারজন হলেন বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ (৪৫), বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর ছেলে মাহবুব পাটওয়ারী (১৪), মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪০) ও বোরহানউদ্দিনের মো. শাহিন।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে, ৪০ জনকে ভোলা সদর হাসপাতালে এবং পাঁচজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক ব্যক্তির বিচারের দাবিতে আজ ঈদগাহ মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে তৌহিদী জনতা। এ সমাবেশের জন্য পুলিশ অনুমতি দেওয়ার আগেই তারা মাইকিং করে। পরে সমাবেশের জন্য পুলিশ অনুমতি না দিলেও সকাল নয়টা থেকে লোকজন মাঠে জড়ো হতে থাকে। মিছিল করতে না পেরে সেখানেই অবস্থান শুরু করে তারা। পরে পুলিশ ‘বাটামারা পীর সাহেব’ মাওলানা মহিবুল্লাহকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করে এবং তাঁকে ঈদগাহ জামে মসজিদের দোতলায় নিয়ে যায়। ওই সময় গুঞ্জন ওঠে, মাওলানা মহিবুল্লাহকে পুলিশ আটক করেছে। এ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছুড়লে চারজন নিহত হন।
পুলিশের দাবি, উত্তেজিত লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করলে তারা গুলি করতে বাধ্য হয়।
অভিযোগ উঠেছে, শুক্রবার বিকেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভর নিজের ছবিসংবলিত ফেসবুক আইডি থেকে আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে গালাগাল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুর কাছে মেসেজ পাঠানো হয়। যাদের মেসেজ পাঠানো হয়, তারা এর স্ক্রিনশট নিয়ে ফেসবুকে দিলে লোকজন প্রতিবাদ জানানো শুরু করে। বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। এ নিয়ে বিভিন্ন মসজিদ থেকে কয়েক দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার পর বিপ্লব চন্দ্র বোরহানউদ্দিন থানায় তাঁর আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে আসেন। এ সময় পুলিশ বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিপ্লব চন্দ্রকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাঁর কথা ধরে পটুয়াখালী থেকে আরেকজনকে গতকাল শনিবার আটক করে।
বিপ্লব চন্দ্রের বিচারের দাবিতে গতকাল সকাল, দুপুর ও বিকেলে বোরহানউদ্দিন উপজেলা শহরে, কুঞ্জেরহাট বাজারে ‘সর্বস্তরের মুসলিম তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। একই দাবিতে আজ সকাল নয়টায় বিক্ষোভের ডাক দেয় তৌহিদী জনতা।
আয়োজকেরা জানান, তাঁরা গতকাল রাতে মাইকিং করার পরে বোরহানউদ্দিন থানার পুলিশের কাছে অনুমতি চাইতে যান। কিন্তু থানা অনুমতি দেয়নি।
আজ সকালের দিকে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এ বিক্ষোভ মিছিলটি না করার জন্য বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল উদ্দিন, বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা মিজানকে পুলিশ অনুরোধ জানায় এবং সাধারণ মানুষ আসার আগে বিক্ষোভটি বন্ধ ঘোষণা করতে বলে। তাদের অনুরোধে এ দুই ইমাম সকাল ১০টার দিকেই যেসব লোক এসেছিল, তাদের নিয়ে দোয়া–মোনাজাতের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিল সমাপ্ত করেন। কিন্তু ততক্ষণে বোরহানউদ্দিনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে ঈদগাহে জড়ো হয়। একপর্যায়ে তারা ওই দুই ইমামের ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং সেখানে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে মসজিদের ইমামের কক্ষে আশ্রয় নেয়। উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে পুলিশ গুলি ছোড়ে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো জেলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বোরহানউদ্দিনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়ছার বলেন, ‘বোরহানউদ্দিন উপজেলার বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। আমরা হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আটক করেছি। আমরা এ নিয়ে গত রাতে স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছে, আজকের প্রোগ্রাম হবে না। কিন্তু সকাল থেকে আমাদের কাছে খবর আসে, সেখানে মাইকিং হচ্ছে এবং স্টেজ বানানো হচ্ছে। সেখানে গিয়ে আমরা উপস্থিত মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি নিজে সেখানে বক্তব্য দিয়েছি। তারা সবাই আমার বক্তব্য শুনেছে। যখন আমি স্টেজ থেকে নেমে আসি, তখন এক দল উত্তেজিত জনতা আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা আত্মরক্ষার্থে একটি রুমে গিয়ে আশ্রয় নিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখন তারা আমাদের রুমের জানালা ভেঙে ফেলে, তখন আমরা প্রথমে শটগানের ফাঁকা গুলি ছুড়ি। এতে কাজ না হওয়ায় ওপরের দিকে গুলি চালানো হয়। আমার জানামতে, একজন পুলিশ সদস্য বুকে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন। আমরা আহত অবস্থায় যাঁদের হাসপাতালে পাঠিয়েছি, তাঁদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন। তবে আরও নিহত থাকতে পারে, সেটা আমাদের কাছে তথ্য নেই।’
এদিকে বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. এনামুল হক জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতে বিপ্লব চন্দ্র নিজের ইচ্ছায় থানায় আসেন। তিনি এখন পুলিশের হেফাজতে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনা সত্য প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় আরেকজনকে আটক করা হয়েছে।
হাটহাজারী থানায় ভাঙচুর
চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। ভোলার বোরহানউদ্দিনে চারজন নিহতের প্রতিবাদে রোববার বিকেলে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, হাটহাজারী ডাকবাংলো চত্বরে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিক্ষোভ মিছিলটি হাটহাজারী থানার সামনে আসার আগে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ালশেল নিক্ষেপ করে ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জনতা একপর্যায়ে হাটহাজারী থানা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর চালায়। এ সময় চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাটহাজারী বাজার, বাসস্ট্যান্ড এলাকার দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি ও হাটহাজারী-রাঙামাটি সড়কে অবস্থান নেয়। এ কারণে বিকেল পাঁচটা থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড চত্বরে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বিক্ষুব্ধ লোকজন সড়কে মাগরিবের নামাজও আদায় করে।
একপর্যায়ে সন্ধ্যার পর হেফাজত ইসলাম মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসার মাইকে ঘোষণা করেন, হেফাজত ইসলাম কোনো কর্মসূচি দেয়নি। কারা কর্মসূচি দিয়েছে হেফাজত জানে না। হাটহাজারী মাদ্রাসার কোনো ছাত্র থাকলে মাদ্রাসায় যেন চলে আসে। এরপর থানার সামনে থাকা লোকজন সরে যেতে থাকেন। তবে মাদ্রাসার সামনে সন্ধ্যা সাতটার দিকেও বিক্ষুব্ধ লোকজন জড়ো থাকে।
আজ রাত পৌনে আটটার দিকে হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুইল চেয়ারে করে মাদ্রাসার প্রধান ফটকের সামনে আসেন। ওই সময় তিনি সড়কে থাকা লোকজনকে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। মাদ্রাসার কোনো ছাত্র থাকলে ঢুকতে বলেন। এরপর পরই সবাই সড়ক থেকে সরে গেলে রাত আটটা থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বেলাল উদ্দীন মো. জাহাঙ্গীর রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেনি। উত্তেজিত কিছু লোক থানায় ভাঙচুর চালায়। ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।