বিল নিয়ে মারামারি-খুনোখুনির এক গ্রাম
শিশু তুহিনের ছোট দেহটির ওপর পৈশাচিকতা নাড়া দিয়েছে দেশের মানুষকে। তবে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কেজাউড়া গ্রামে মারামারি, মামলা, খুনোখুনি নতুন কিছু নয়। হাওরপাড়ের এই গ্রামের আটটি বিলের দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘদিনের। গত ১৮ বছরে দুই পক্ষের মধ্যে চারটি হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়। মারামারি হয় প্রায়ই। এসব নিয়ে মামলাও হয়েছে প্রচুর। সংঘর্ষ–মারামারিতে ত্যক্ত–বিরক্ত গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ, অনেকে সর্বস্বান্ত মামলায়। ওই বিবাদের জেরেই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গত রোববার রাতে শিশু তুহিনকে তারই বাবা–চাচারা পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন।
দিরাইয়ের কালিয়াকোটা হাওরের পূর্বপাড়ে কেজাউড়া গ্রাম। ৪০০–র মতো পরিবারের বাস। গ্রামের আটটি বিল নিয়ে আবদুল মছব্বিরের পরিবারের সঙ্গে সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেনের লোকজনের দ্বন্দ্ব। আনোয়ারের পক্ষে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু মছব্বিরের বড় পরিবার, লোকজন বেশি। মছব্বিরের ভাই নিহত শিশু তুহিনের বাবা আবদুল বাছির। তুহিন হত্যায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বাছির, মছব্বিরসহ পাঁচজন। এর মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন।
জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানালেন, কেজাউড়া গ্রামের বিল নিয়ে মারামারি, হত্যাসহ সাত–আটটি মামলা এখনো তদন্তাধীন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে বিল নিয়ে আনোয়ার মেম্বার ও মছব্বিরের পরিবারের মধ্যে মারামারি হয়। সালিসের তারিখ নির্ধারণ হয়। সালিসের আগের দিন ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় গ্রামের রাস্তার পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় মছব্বিরের এক ভাইয়ের ছেলের স্ত্রী নিলুফা বেগমের লাশ পাওয়া যায়। তাঁর শরীরে ধারালো অস্ত্রের ৩১টি আঘাত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাছিরের পরিবারের লোকজন আনোয়ার মেম্বারের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট চালায়। এরপর মামলা হয় আনোয়ারসহ তাঁর ১৬ জন আত্মীয়ের বিরুদ্ধে।
নিলুফা হত্যা মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী হাসান মাহবুব জানান, মামলাটি এখন আদালতে যুক্তি-তর্কের পর্যায়ে আছে। ওই মামলায় আনোয়ার মেম্বার, সালাতুল, সোলেমান মিয়াসহ ১৬ জন আসামি।
শিশু তুহিনের দেহে যে দুটি ছুরি আটকানো ছিল তার বাঁটে লেখা ছিল নিলুফা হত্যা মামলার আসামি সোলেমান মিয়া ও সালাতুলের নাম। দুজনেরই বয়স ষাটের কোঠায়। গ্রামে গিয়ে জানা গেল নানা রোগে কাবু দুজনই। সোলেমান মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তিনি শয্যাশায়ী। তিনি বলেন, তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে এক মাস ধরে শয্যাশায়ী, অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারেন না। অথচ তুহিন হত্যার পরে তাঁর নাম জোরেশোরে বলা শুরু করেছিলেন বাছির ও মছব্বিররা।
এর আগে ২০০৮ গ্রামে মছব্বিরদের এক আত্মীয় জবর আলীকে হত্যার অভিযোগে আনোয়ার মেম্বার ও তাঁর লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। জবর আলীর লাশ পাওয়া গিয়েছিল গ্রামের পাশের একটি বিলের কাদামাটিতে পোঁতা অবস্থায়। পরে পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ দুই দফা তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ওই মামলার আসামি ছিলেন গ্রামের এলাইছ মিয়া। গতকাল তিনি জানান, মামলাটি ছিল ভুয়া। জবর আলী নিজের ঘরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে তাঁর লোকজনই তাঁর লাশ হাওরে নিয়ে কাদাপানিতে পুঁতে রেখে হত্যা মামলা করেন।
হুমায়ন কবীর নামের গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, এর আগে ২০০১ সালে গ্রামের পাশের রাস্তায় মুজিব মিয়া নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর শরীরে ৬৪টি আঘাতে চিহ্ন ছিল। এই মামলার অন্যতম আমি তুহিনের বাবা আবদুল বাছির।
হামলা-মামলায় ত্যক্ত–বিরক্ত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘গ্রামে কেউ কাউকে মানে না। দুটি পক্ষ রয়েছে। তাদের মধ্যে হানাহানি শেষ হচ্ছে না। কোনো ঘটনা শেষ হতে না–হতেই আরেকটা ঘটায় তারা। নিলুফা হত্যার মামলাটি আপসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই সময় ঘটল তুহিন হত্যা। মনে হয় এই গ্রামে আর থাকা যাবে না।’
তুহিনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল আধা পাকা টিনশেড ঘরে থাকেন তুহিনের বাবা–চাচাদের চারটি পরিবার। তুহিনের মা মনিরা বেগম নেই। তবে কথা হয় বাছির–মছব্বিরের সৎমা লুৎফা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তারা আছে মারামারি-কাটাকাটি নিয়া।’ প্রতিবেশী হেনা বেগম জানালেন, তুহিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে গ্রামের শিশুরা ভয় পেয়েছে। অনেক শিশু ভয়ে বিদ্যালয়ে যেতে চাচ্ছে না।