ছাত্রলীগের নৃশংসতার শেষ কোথায়
কোনো কিছুতেই থামছে না ছাত্রলীগ। চাঁদাবাজি আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন দাবিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্যাসিনো, জুয়া ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে যুবলীগ, কৃষক লীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রায় ১১ বছর ধরে ছাত্রলীগ মূলত আলোচনায় এসেছে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই কিংবা টেন্ডারবাজির কারণে। গত রোববার রাতে একইভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারকে হত্যা করে আবারও শিরোনামে এসেছে ছাত্রলীগ। ভালো কাজের জন্য ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে—এমন নজির নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনটির সংগ্রামের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে কোনো একটা মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হয়ে থাকলে তা খুবই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে আর কী বাকি থাকল? তাঁর মতে, ছাত্রলীগ এখন যা করছে এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের দুর্নীতি বের হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা নৃশংসতা করছে। আমরা তো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এভাবে তো চলতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি অংশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অনুষ্ঠানে তাঁদের সতর্ক করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তাতে সাময়িক থামলেও বন্ধ হয়নি। এ থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে, এর কোনো উত্তর নেই তাঁদের কাছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বুয়েটের ঘটনা দুঃখজনক। তবে সরকার কাউকে ছাড় দেবে না। এর আগেও কেউ অপকর্ম করে ছাড় পায়নি। তিনি বলেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পরিবর্তন করেছেন। যুবলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। পাশাপাশি ভালো কাজের প্রেরণা দেওয়া হবে।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। প্রথম আলোর হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন।
২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। ২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিৎ দাস।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাঁদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছেন সংগঠনটির কর্মীরা। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের মতো আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হকের ওপর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত সাতবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন দাবি, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়া, অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন নেতৃত্ব আসার পরও থামেনি ছাত্রলীগ।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাঁদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করলে সেখানেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির থাকছে ছাত্রলীগের কারণেই।
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী বা অপরাধীর কোনো সাংগঠনিক পরিচয় নেই। ছাত্রলীগের নীতি-আদর্শের বাইরে কেউ কিছু করলে এর দায় সংগঠন নেবে না। বুয়েটের ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিটা আইন-আদালতের কাজ। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
দীর্ঘ সময় দল ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের প্রায় সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দল টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতেও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটা যেমন দলের ভেতরে, তেমনি দলের বাইরেও। এমনকি সাধারণ ও পড়ুয়া ছাত্রদের কাছেও এই সংগঠনের কিছুসংখ্যক নেতা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, এই ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন। আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো সবাই জানেন। এমনকি এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সংগঠনটির আদর্শ ও দায়বদ্ধতা দেখা গেছে। কিন্তু এখন যা দেখা যাচ্ছে তা কল্পনারও বাইরে। তাঁর মতে, বুয়েটে যা ঘটেছে, তা ন্যক্কারজনক। প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। তবে ছাত্রসংগঠনগুলোকে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখে শুদ্ধ করা যাবে না।