আর্থিক বিষয়ে ছাত্রীর সঙ্গে সহ-উপাচার্যের ফোনালাপ নিয়ে রাবিতে নানা আলোচনা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে এক চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার আর্থিক লেনদেনের দর-কষাকষির একটি ফোনালাপে আলোড়ন তৈরি করেছে।
সমালোচনার মুখে আজ মঙ্গলবার বিকেলে সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়ে বলেছেন, ফাঁস হওয়া অডিও সম্পাদনা করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘নুরুল হুদা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার ছাত্রজীবনের শুরু থেকে আমি স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে দেখভাল করছি। তার লেখাপড়ার চলমান রাখতে তাকে দুটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারি নুরুল হুদা চাকরি পেতে অসাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার একটি স্লিপও আমার নজরে আসে। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে তার এহেন অসাধুকর্ম রোধে খোঁজ নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। কারণ, হুদার স্ত্রীর বাড়ি সৈয়দপুরে। হুদার স্ত্রী সে সময় ব্যাংক লেনদেনের বিষয়টি স্বীকারও করে বিস্তারিত বলতে রাজি হয়নি।’
এ বিষয়ে নুরুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকেই এ বিষয়ে ফোনের পর ফোন পেয়ে আমি বিরক্ত। আমি রাতে জার্নি করেছি। এখন একটু ঘুমাব। পরে ফোন দেন।’ তবে পরে একাধিকবার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে নুরুল হুদার স্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
গত সোমবার রাতে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল তাদের ফেসবুক পাতায় ওই অডিও প্রকাশ করে। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ওই অডিওতে সগ-উপাচার্যের সঙ্গে প্রভাষক পদে আবেদন করা আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নুরুল হুদার স্ত্রী তুজ সাদিয়াকে কথা বলতে শোনা যায়। সাদিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৬৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬০ পান। আইন অনুষদে সেরা হওয়ায় ২০১৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান। তাঁর বাড়ি সহ-উপাচার্য জাকারিয়ার এলাকা লালমনিরহাটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে এক সার্কুলারে বিভাগে ৩টি প্রভাষক পদের বিপরীতে মোট আবেদন করেন ৪১ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে সিজিপিএ ৩.৫০ বা এর ঊর্ধ্বে ফল ছিল। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩৩ জন আবেদনকারী ফল ৩.৫০ বা এর ঊর্ধ্বে ছিল। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর নিয়োগের জন্য ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ অনুমোদিত হয়। পরদিন ১৮ নভেম্বর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিভাগে যোগ দেন।
তবে নুরুল হুদা নিয়োগ পাননি।
সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার ফোনালাপ—
সহ-উপাচার্য: হ্যাঁ, তুজ সাদিয়া। আমি প্রফেসর জাকারিয়া (চৌধুরী মো. জাকারিয়ার), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
সহ-উপাচার্য: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলত, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: স্যার, সত্যি কথা বলতে...
সহ-উপাচার্য: না না, সত্যি কথাই তো বলবা। ওপরে আল্লাহ তালা, নিচে আমি।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তাঁর (নরুল হুদা) অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার...মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক প্রিন্সিপালের (নীতির বিষয়ে কঠোর) ..., আপনি বোধ হয় এটাও জানেন স্যার, একটু রগচটা ছেলে।
সহ-উপাচার্য: আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না।
আইন বিভাগের ওই নিয়োগে নির্বাচনী বোর্ডে সহ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াও ছিলেন বলেন জানিয়েছেন আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য রুস্তম আলী, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মন্ডল ও বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, ‘আমি নির্বাচনী বোর্ডে অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিলাম। তবে অর্থের লেনদেন সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে একটু গুজবের মতো শুনেছিলাম, অর্থ লেনদেন হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ যে সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হওয়ার সময় আমি ছিলাম। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ। আমার কাছে সবই সাজানো নাটক মনে হয়েছে। আগে থেকে সবই নির্ধারিত ছিল কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক পেল, আবার প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পেল, তারপরেও চাকরি হলো না। আমি বিস্মিত।’
এদিকে ৪৮ সেকেন্ডের ওই অডিও ফাঁস হওয়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্রসংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা মশাল মিছিল করার ঘোষণা দেয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলে তারা ২ অক্টোবর পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেন। মশাল মিছিলে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে জড় হন ছাত্র ফেডারেশন, রাকসু আন্দোলন মঞ্চ, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘আমরা মশাল মিছিলের প্রস্তুতি নিই। তখন প্রক্টরিয়াল বডি এসে আমাদের এ বিষয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। আমাদের সঙ্গে কাল বুধবার দুপুরে বসার কথা। এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে আমরা বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলনে নামব।’
এদিকে সন্ধ্যায় প্রগতিশীল ছাত্রজোট সংবাদ সম্মেলনে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নৈতিক স্থলনের অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবি জানান। জোটের সাবেক সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর শাখা সাধারণ সম্পাদক রঞ্জু হাসান বলেন, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে তিনি মেয়ের জামাইকে নিয়োগ দিয়েছেন। আর ফোন আলাপে তাঁর শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য স্পষ্ট হয়েছে। আমরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম ফারুকী বলেন, ‘আমরা শিক্ষক সমিতি কাল বুধবার এ বিষয়ে বসব। বসার পর এ বিষয়ে জানাব।’