বেহাল রাস্তায় পর্যটকশূন্য কাদিগড় উদ্যান
শালবনের প্রায় ৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির বন্য প্রাণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বসবাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাদিগড় জাতীয় উদ্যানে। কিন্তু বেহাল রাস্তার কারণে ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে পারছে না এই উদ্যান।
বনভূমি রক্ষার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজমের কথা চিন্তা করে ২০১০ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের পালগাঁও ও কাদিগড় মৌজায় প্রায় ৯৫০ একর বনভূমি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরেও উদ্যানটির চারপাশের সীমানাপ্রাচীর ও যোগাযোগব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে কোনো পর্যটক উদ্যানে যান না বললেই চলে।
গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সিডস্টোর বাজার থেকে পশ্চিম দিকের বেহাল রাস্তায় প্রায় ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর ২ কিলোমিটার উত্তরে পালগাঁও চৌরাস্তায় কাদিগড় জাতীয় উদ্যানের প্রধান প্রবেশদ্বার। উদ্যানের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ছোট একটি জলাশয়। ফটকটি খোলা অবস্থায়। দুই পাশে দুটি টিকিট কাউন্টার। তবে সেখানে কেউ নেই। ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল গবাদিপশু। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পাওয়া গেল পিকনিক স্পট। বাঁ দিকে দুটি একতলা ভবন। একটি পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য, আরেকটি বন কর্মকর্তাদের জন্য। সেখানে পাওয়া গেল বন বিভাগের এক মালিকে। তবে তাঁর কাছে এই উদ্যানের কোনো তথ্য নেই।
বন কর্মকর্তার ভবন থেকে বের হয়ে আরেকটু দক্ষিণে দেখা গেল ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণে দেখা মেলে বানরের দলের। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফালাফি করছে। দক্ষিণ দিকে বেশ কয়েকজন রাখাল গরু চরাচ্ছেন। পশ্চিম দিকে দেখা মিলল একটি ছোট লেক ও একটি একতলা ভবনের। ওয়াচ টাওয়ারের চারদিকেই বিভিন্ন বয়সের অন্তত ১৭ জন ব্যক্তি ধানের খেতের আলে বসা ছিলেন। সেখানে গেলে ৬০ ছুঁইছুঁই আমছর আলী জানান, তিনি তাঁর জমিতে ধান লাগিয়েছেন। বানর এসে সেই ধান নষ্ট করে ফেলে। তাই তিনি সেখানে বাডুল হাতে নিয়ে বসে আছেন। বানর আসামাত্রই বাডুল ছোড়া হয়। অন্যরাও একই কাজে খেতের আলে বসে আছেন।
সেখান থেকে পশ্চিম দিকের ওই ভবনের উদ্দেশে যাওয়ার পথে দেখা মিলল সাতজন কিশোরের একটি দলের। তারা সেখানে বসে গিটার হাতে মনের আনন্দে গান করছে। ভবনে গিয়ে দেখা গেল স্থানীয় এক বহিরাগত পরিবারের বসবাস। যদিও পর্যটকদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভবনটি করা হয়ছে। কিন্তু তাঁদের দাবি, বেহাল রাস্তার কারণে পর্যটকেরা না আসায় তাঁরা বসবাস করেন।
পাশেই পর্যটকদের ব্যবহারের জন্য শৌচাগারের ওপরে লতানো গাছ জন্মেছে। দীর্ঘদিন ধরে দরজার তালা না খোলায় তাতে মরিচা পড়েছে। লেকের পাড়সহ পর্যটকদের বসার স্থানগুলোতে গাছের পাতা পচে আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিডস্টোর বাজার থেকে লাউতি খালের সেতু পর্যন্ত রাস্তার পুরো অংশেই ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। আমছর আলীর বাড়ির পাশে রাস্তায় বড় গর্তে পানি জমে আছে। রানারের ২ নম্বর গেট এলাকার ভাঙা রাস্তায় পানি জমে ছোট জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। রানারের ১ নম্বর গেট, আফছর খাঁ মোড়েও একই অবস্থা। সিডস্টোর-সখীপুর রাস্তায় বড় কোনো যান চলাচল করে না। এসব গাড়ি বিকল্প রাস্তা হিসেবে পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে বাটাজোর বাজার থেকে ডাকাতিয়া চৌরাস্তার মোড় হয়ে ভালুকা উপজেলা সদরে ঢোকে। তবে কাচিনা বাজার থেকে মল্লিকবাড়ি রাস্তার সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।
সিডস্টোর-সখীপুর রাস্তাটি প্রায় এক যুগ ধরে সংস্কার হয় না। ফলে ভালুকার অংশের কার্পেটিং উঠে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সালেহ ইমরান বলেন, সিডস্টোর-সখীপুর রাস্তার কার্পেটিং উঠে গর্তে বৃষ্টির পানি জমে যায়। এতে যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে পড়ে রাস্তাটি। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের বিশেষ করে পোলট্রি, মাল্টা ও লেবুচাষিদের পণ্য পরিবহনে বিপাকে পড়তে হয়।
ভালুকার রেঞ্জের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন জানান, যোগাযোগব্যবস্থা বেহালের কারণে কাদিগড় জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের আগমন কম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও বিআইটিএমের অধ্যক্ষ নোমান রাহিদ বলেন, এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ছাড়াও নিরাপত্তা, বিশ্রামাগার, বিনোদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাদিগড় জাতীয় উদ্যানকে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় এনে প্রচারণা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এ ছাড়া জেলার পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে আরও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। উদ্যানে যাতায়াতের বেহাল রাস্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভালুকার ইউএনওকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেটি দেখার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।