কাঠমিস্ত্রি নারায়ণের গ্রন্থাগার

নারায়ণ মিস্ত্রি গ্রন্থাগারের প্রবেশপথের সামনে একটু খালি জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি (৫০) কাঠের ওপর খোদাই করে মনীষীদের কাঠচিত্র তৈরি করছেন। গ্রন্থাগারের ভেতরে পাঠকেরা পছন্দের বই নিয়ে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। সম্প্রতি ওই গ্রন্থাগারে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

ঝালকাঠি শহরে উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপণিবিতানের ভেতরে দুই কক্ষের এই গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়েছে। নারায়ণ চন্দ্রের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। নারায়ণ চন্দ্র (৫০) একজন কাঠমিস্ত্রি। এ পেশা থেকে আয়ের বাড়তি একটি অংশ বাঁচিয়ে গ্রন্থাগার তৈরি করেছেন। তাঁর এই প্রতিষ্ঠান ১৬ বছর ধরে ঝালকাঠিতে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে।

২০০৩ সালে ঝালকাঠি শহরের বাঁশপট্টি এলাকায় ভাড়া বাসার বারান্দায় ২০টি বই দিয়ে গ্রন্থাগারের কার্যক্রম শুরু করেন নারায়ণ চন্দ্র। এ বছরের জুলাই থেকে শহরের উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মালিকানাধীন মার্কেটের ভেতরে দুটি কক্ষে গ্রন্থাগারটি চলছে। এখানে গ্রন্থাগার স্থাপনে আর্থিক সহায়তা করেছেন সাবিহা কেমিক্যাল ওয়ার্কসের নির্বাহী পরিচালক শামিম আহমেদ। তিনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চার লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে দুটি কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ভাড়ার টাকা দিচ্ছেন। পাশাপাশি নারায়ণ মিস্ত্রি নিজেই প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে বই রাখার তাক তৈরি করেছেন। বর্তমানে এ গ্রন্থাগারে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দেশি-বিদেশি বই আছে।

শুরুর কথা

নারায়ণ মিস্ত্রির বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের বিহারীপুর গ্রামে। অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণির পর তাঁকে বিদ্যালয় ছাড়তে হয়। কাজের সন্ধানে চলে যান কলকাতায়। সেখানে দুই বছর কাঠের কাজ শিখে ঝালকাঠিতে এসে আসবাব তৈরির দোকানে কাজ নেন। পরে নিজেই আসবাব বিক্রির দোকান দেন। বর্তমানে শহরের বাঁশপট্টি এলাকায় নারায়ণ মিস্ত্রির আসবাব বিক্রির দোকান। তাঁর গ্রন্থাগারে রয়েছে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনসহ বহু বিখ্যাত মানুষের কাঠচিত্র। এসবই নারায়ণ মিস্ত্রির নিজের হাতে নকশা করা। আসবাব ছাড়াও কাঠের নকশায় ছবি এঁকে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। কারও ছবি একবার দেখে কাঠের ওপর তাঁর মুখের রূপ দিতে পারেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে নারায়ণ মিস্ত্রির সংসার। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার ফাঁকে গ্রন্থাগারের কাজে বাবাকে সাহায্য করেন।

নিজের এই উদ্যোগ সম্পর্কে নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি বলেন, ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি লেখা দেখেছিলাম—বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। ওই লেখাই আমার গ্রন্থাগার তৈরির প্রেরণা। লেখাটা পড়ে প্রথমে নিজের জন্য দু–একটি করে বই কিনি। পরে ভাবলাম, বইগুলো সবাইকে পড়াতে পারলে সবার অনেক উপকার হবে। মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারব। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি।’

সরেজমিনে একদিন

গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণ মিস্ত্রি গ্রন্থাগারের সামনে কাঠের ওপর নকশা করতে ব্যস্ত। সকাল সকাল কয়েকজন পাঠক হাজির। কেউ বই পড়ছেন, কেউবা পত্রিকা দেখছেন। বিভিন্ন তাকে বই সাজানো। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে কাঠে খোদাই করা বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাঠচিত্র ও ভাস্কর্য।

>

অভাবের কারণে খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি নারায়ণ চন্দ্র। তবে সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে তুলেছেন গ্রন্থাগার।

নারায়ণ মিস্ত্রি জানান, প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা থাকে। তবে শুক্রবার খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে। পাঠকসংখ্যা এখন প্রায় দেড় হাজার। ২০১৩ সালে এটি গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের তালিকাভুক্তির সনদ পায়। তিনি এখন পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পেয়েছেন।

গ্রন্থাগারের পাঠক স্কুলশিক্ষক মিলন রায় বলেন, সাহিত্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম-দর্শনসহ পাঠকের পছন্দসই সব ধরনের বই গ্রন্থাগারটিতে আছে। এই গ্রন্থাগারে পড়ালেখা করে উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হচ্ছে।

আরেক পাঠক কামরুল হাসান বলেন, ‘নারায়ণ মিস্ত্রি একজন কাঠমিস্ত্রি হয়েও নিজের শ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে গ্রন্থাগারটি গড়ে তুলেছেন। এখানে আমি নিয়মিত পড়াশোনা করি। অন্যদেরও এখানে আসতে বলি। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলের ১৫টি খণ্ড, ভারতীয় দর্শন, রবীন্দ্ররচনা সংগ্রহসহ অনেক দুর্লভ বই আছে।’

উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হিমেল রায় বলে, ‘আমি এখানে কার্টুনের বই পড়তে আসি। নারায়ণ কাকার কাছে মজার মজার কার্টুনের বই আছে।’

গ্রন্থাগার স্থাপনের পাশাপাশি পাঠক তৈরিতেও কাজ করছেন নারায়ণ মিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘গ্রন্থাগার হচ্ছে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সাল থেকে মানুষের বাড়িতে গিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে বই পড়িয়ে কয়েক হাজার পাঠক তৈরি করেছি। অনেক বই ফেরত পাইনি। তারপরও আমি খুশি, মানুষের মধ্যে বই পড়ার আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আলমারির অভাবে এখনো প্রায় ৩০০ বই বাসায় বস্তাবন্দী। মাসিক পত্রিকার বিল দিতে আমার কষ্ট হয়। এ বিষয়ে সচ্ছল ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা দরকার।’