বিলের পানিতে পদ্ম শাপলার শোভা
পদ্ম পাতায় জল কিংবা গোবরে পদ্মফুল—বাংলা ভাষায় বাগ্ধারা হিসেবে বহুল প্রচলিত। আবার পদ্মাসন যেমন জনপ্রিয় একটা যোগাসন, তেমনি পবিত্রতা বা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেও পদ্মের নাম ঘুরেফিরে আসে। বই কিংবা ক্যালেন্ডারের পাতায় ছাপা ছবির বাইরে এই ইট–কাঠের নগরে বেড়ে ওঠা বাসিন্দাদের স্বচক্ষে বিলেঝিলে ফোটা পদ্মের শোভা দেখার সুযোগ সীমিত। অথচ সেই ভাদ্রের শুরু থেকে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার জিন্দা গ্রামে বিলের পানিতে মনোহর পদ্মের সঙ্গে আসন পেতে আছে লাল আর নীল শাপলা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এরই মধ্যে জিন্দা মধ্যপাড়ায় অবস্থিত এই বিল অনেকের কাছেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। ভরমৌসুমে বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে প্রচুর মানুষ ভিড় করে গ্রামীণ পরিবেশে বিলের পানিতে ফুটে থাকা এসব জলজ ফুলের শোভা দেখার জন্য।
জিন্দা গ্রামটি রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেখানে যেতে হলে ঢাকা থেকে পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়ক ধরে সোজা এগোতে হবে কাঞ্চন সেতুর দিকে। সেতুর আগে বাঁয়ে মোড় নিয়ে কয়েক কিলোমিটার যেতে পড়বে পলখান বাজার মোড়। মোড় থেকে স্থানীয় সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার গেলেই জিন্দা গ্রাম। সেখানে পৌঁছে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই পাওয়া যাবে পদ্মবিলের হদিস।
গত বৃহস্পতিবার গ্রামের মধ্যপাড়ার সড়ক ধরে যেতে যেতে চোখে পড়ল সরু রাস্তার দুপাশে বাঁশঝাড়সহ সবুজ বৃক্ষের সমাবেশ। মাঝেমধ্যেই এদিক–ওদিক থেকে ভেসে আসা নানা প্রজাতির পাখির ডাক নৈশব্দের জগৎটাকে ভেঙে দিচ্ছে। গ্রামের উত্তরমুখী এই সড়ক ধরে খানিক দূর যেতেই দেখা গেল, দুই পাশের বিস্তৃত জলরাশির বুকে দল মেলে ফুটে আছে নয়নজুড়ানো গোলাপি পদ্ম আর নীল শাপলা। বেলা বেড়ে যাওয়ায় লাল শাপলাগুলো ততক্ষণে নিজেদের পাপড়ি গুটিয়ে নিয়েছে।
গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সড়কের বাঁ পাশের বিলটির নাম লাউয়াইল। আর ডান পাশের বিলটি পরিচিত আইড়াইল নামে। বাসিন্দারা বলছেন, সাধারণত ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এই দুই বিলে পদ্ম ও শাপলা ফুটতে শুরু করে। স্থানীয়দের বাইরে আগে এই জায়গাটির খোঁজ খুব বেশি মানুষ জানত না। তবে ফেসবুকের কল্যাণে গত দুই–তিন বছর ধরে জায়গাটি খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে।
মধ্যপাড়ার সড়ক ধরে জিন্দা গ্রামের সীমানা যেখানে শেষ, সেই জায়গাটিই ফুলের শোভা দেখার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা। এরপরের গ্রামটির নাম হানকুড়। দেখা গেল জিন্দা ও হানকুড়ের সংযোগস্থলে সেতুর গোড়ায় ডান পাশে বিলে বেড়ানোর জন্য চারটি ছোট নৌকা বেঁধে রাখা। চোখে পড়ে, আইড়াইল বিলের জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি কিছু ওয়াচ টাওয়ার। জানা গেল, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা শাপলা বিল রিসোর্ট এই ওয়াচ টাওয়ার ও নৌকার বন্দোবস্ত রেখেছে।
দুপুরের পর তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে এখান থেকে প্রতি ঘণ্টা ৩০০ টাকার চুক্তিতে একটা নৌকা ভাড়া করে ভেসে পড়া গেল আইড়াইলের বুকে। নৌকার মাঝি মো. মিঠু এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে জানায়, পদ্ম–শাপলার শোভা দেখার প্রকৃষ্ট সময় হচ্ছে সকালবেলা। সকালে পরিবেশ নির্মল থাকে। সেই সঙ্গে ফুটন্ত লাল শাপলা দেখারও সুযোগ মেলে।
পরবর্তী এক ঘণ্টায় নৌকায় ভাসতে ভাসতে শত শত পদ্ম–শাপলার শোভা দেখার পাশাপাশি মন কেড়ে নেয় অগভীর–স্বচ্ছ পানিতে সাঁতরে বেড়ানো হাঁস আর ছোট মাছের ঝাঁক। মাঝেমধ্যেই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বকের সারি, পদ্মের বড় বড় পাতার ওপর বসে থাকা সোনাব্যাঙের লাফ আর ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। বিলের বাতাসে মন হয়ে ওঠে উদাস।
পদ্ম ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম nelumbo nucifera। সারা বছর পানি থাকে এমন জায়গায় পদ্ম ভালো জন্মে। তবে খালবিল, হাওর, বাঁওড় ইত্যাদিতেও এই উদ্ভিদ জন্মে।
সবজি হিসেবে বাজারে লাল ও সাদা শাপলার চাহিদা থাকলেও জিন্দা, হানকুড়সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা এগুলো তোলেন না। কারণ জানতে চাইলে নৌকার মাঝি মিঠুন বলে, ‘ফুল ফুটলে কত সুন্দর দেখায়। দূর থেকে কত মানুষ এই সৌন্দর্য দেখতে আসে। তাই গ্রামের মানুষ সাধারণত বিল থেকে শাপলা তোলে না।’